
Muhammad Motahar Hossain (মুহাম্মদ মোতাহার হোসেন)
আওয়ামীলীগ সরকার পরিবেশ রক্ষার আড়ালে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ, সম্ভাবনাময় জাহাজ ভাঙা শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে যে তা কি আপনারা জানেন?
ধাপে ধাপে কয়েক বছরের পরিকল্পনায় এই শিল্পকে সংকুচিত করে, এর সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিককে বেকার করে, নির্মাণ সামগ্রীকে কিভাবে ভারত থেকে আমদানি নির্ভর করে ফেলা হয়েছিল আজ সেইটাই আপনাদের কাছে প্রমাণসহ তুলে ধরবো।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (BELA)-এর একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের Writ Petition No. ১৬৮০৫/২০০৬-২০০৯ রায়ে পরিবেশ দূষণ ও শ্রমিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি দেখিয়ে চট্টগ্রামের সব জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ড বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। (৩ ডিসেম্বর ২০১০ The Daily Star)
আমাদের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হলেন এই BELA-র প্রধান নির্বাহী।
২০১১ সালে সরকার Basel Convention এবং ILO-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে "Ship Breaking and Ship Recycling Rules, 2011" প্রণয়ন করে। এরপর ২০১৮ সালে সংসদের মাধ্যমে "Ship Recycling Act" পাস করে। (Bangladesh Gazette- Act No. 08 of 2018)
২০২৩ এসে পুরানো জাহাজ আমদানীতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও গ্রিন রিসাইক্লিং বাধ্যতামূলক করার জন্যে বাংলাদেশ IMO-এর অধীনে Hong Kong International Convention (HKC) অনুমোদন বাধ্যতামূলক করে দেয়।
অথচ বাংলাদেশে তখন HKC কমপ্লায়েন্ট ইয়ার্ড মাত্র ৭ টি, এবং HKC বাধ্যতামূলক করার আগে তা বাড়ানোর কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। যদিও এটি ২০২৫ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাব কার্যকর হওয়ার কথা। (IMO রিপোর্ট, ২৬ জুন ২০২৩)
অন্যদিকে ভারত সরকার ২৮ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে এই কনভেনশনটি সার্টিফাই করে Alang Shipbreaking Yard-এর ১১০টির মধ্যে ৭০+ ইয়ার্ড HKC-কমপ্লায়েন্ট হিসাবে গড়ে তোলে।
এই নিয়ন্ত্রণগুলোর ফলে বাংলাদেশের শিল্পটি "রেড ক্যাটাগরি"তে নেমে যায়, যা জাহাজ ক্রয়ের ক্লিয়ারেন্স পেতে বিলম্ব সৃষ্টি করে।
ফলাফল কি হয়েছে জানেন?
চট্টগ্রামের ১৫০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে ২০২৪ সালে সক্রিয় থাকে মাত্র ৩০-৩৫টি। শুধুমাত্র HKC-এর কারণেই ৪০% (প্রায় ৬০টি) ইয়ার্ড পুরোপুরি বন্ধের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। ফলে, ৩ লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে আনুমানিক ১ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে।
জাহাজ ভাঙা থেকে স্ক্র্যাপ স্টিলের উৎপাদন ২০০৯ এর তুলনায় ২০২৪ এ এসে ৫০% কমে যায়। যেখানে বাংলাদেশের স্টিল শিল্পের ৬০-৭০% কাঁচামাল জাহাজ ভাঙা থেকে আসত, কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের ফলে এটি এসে দাঁড়ায় মাত্র ৪০-৫০% এ।
২০০৯-এ যেখানে ২২০টি জাহাজ ভেঙে ২.২ মিলিয়ন টন স্ক্র্যাপ উৎপাদন হয়েছিল সেখানে ২০২৪ এ এসে মাত্র ১৪৪টি জাহাজ ভেঙে মাত্র ০.৯৬৮ মিলিয়ন টন স্ক্র্যাপ উৎপাদন হয়। (The Business Standard (2025): “Scrap ship imports drop to two-decade low in 2024.”Human Rights Watch (2023): “Trading Lives for Profit.”The Daily Star (2025): “Bangladesh Shipbreaking Industry.”)
ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া ও জাহাজ ক্রয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে ২০২৩ সালে প্রায় ৪২ টি জাহাজ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যায়। টাকার অংকে যে ক্ষতি আনুমানিক ৬,০০০ কোটি টাকার।
Fairmouth ছিল একটি অয়েল ট্যাঙ্কার। ২০২৩ এর মে মাসে বাংলাদেশ ২০ মিলিয়ন ডলার (২২০ কোটি টাকা) প্রস্তাব করে জাহাজটির জন্যে। ভারতের Alang Yard এর Priya Blue কোম্পানি জুন মাসে সেই জাহাজ ১৮ মিলিয়ন ডলার (১৯৮ কোটি)-এ কিনে নেয়।
Suvarna Swariya ও ট্যাঙ্কার। ২০২৪ এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ১৫ মিলিয়ন ডলার (১৬৫ কোটি) দরদাম করে। এবারও ভারতের Alang Yard এর Bansal Group ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩.৫ মিলিয়ন ডলার(১৪৮ কোটি)-এ জাহাজটি কিনে মার্চে ভাঙে। তখন দুর্ঘটনায় সেখানে ৬ শ্রমিক মারা যায়।
Catherine Bright ছিল বাল্কার। ২০২৩ এর শেষের দিকে এই জাহাজ বাংলাদেশ ১২ মিলিয়ন ডলার (১৩২ কোটি) দাম করে। ভারতের Alang Yard ২০২৪ এর জানুয়ারিতে জাহাজটি ১০.৫ মিলিয়ন ডলারে (১১৫ কোটি) কিনে ফেব্রুয়ারিতে ভাঙে।
এই জাহাজগুলোর প্রতিটাই "regulatory arbitrage"-এর ফলে বাংলাদেশের হাতছাড়া হয় আর ভারত কিনে নেয়। কারন এই "regulatory arbitrage"-এ পরিবেশ ক্লিয়ারেন্স দিতে বাংলাদেশের অধিদপ্তর সময় নেয় ১-৩ মাস আর ভারতের সময় লাগে ১ সপ্তাহ বা কয়েকদিন বেশি। (রেফ: NGO Shipbreaking Platform, ২০২৪; Robin des Bois Report, ২০২৪, Fortune Business Insights (২০২৩), Financial Express ১০ মে ২০২৫।)
এই বার এই লেখার আসল পয়েন্ট। এখানেই দেখবেন কত দারুন পদ্ধতিতে আমাদেরকে ভারতের উপর নির্ভরশীল করে ফেলা হয়েছিল।
Observatory of Economic Complexity (OEC) এর তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ভারত থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের আয়রন ও স্টিল পণ্য আমদানি করে। ২০২১ সালে এসে সেই আমদানি দাঁড়ায় ১০৯ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে বাংলাদেশ ভারত থেকে স্টীল স্ক্র্যাপ আমদানি করে ২৪১ মিলিয়ন ডলারের, যা ২০২১-এর তুলনায় ১৩২ মিলিয়ন ডলার বেশি (১২০% বৃদ্ধি)।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে যে আমদানি হয় তা ২৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ২০২৪ এর COMTRADE রিপোর্ট এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে ধারণা করা হয় এটি ২৩ সাল থেকে বাড়বে।(OEC (২০২২): Bangladesh imports Iron or steel articles. The Business Standard (২০২৪): “Rise of shipbreaking industry in Bangladesh.” Fastmarkets (১৪ এপ্রিল ২০২৩): “Robust construction, shipbreaking activity spur growth.”)
ভারতের Alang-এর তুলনায় বাংলাদেশের শ্রম খরচ কম, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কারণে ভারত এখন বাংলাদেশকে টপকে যাচ্ছে।
২০২২ সালে দেশের মোট স্ক্র্যাপ আমদানি ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়ায়, যা রিজার্ভে একটি বড়সড় প্রভাব ফেলে। (Bangladesh Bank, ২০২৩)। নির্মাণ খরচ বৃদ্ধি পেয়ে MS Rod এর দাম ৯০,০০০ টাকা/টন ছাড়িয়ে যায়।
এভাবেই পরিবেশ রক্ষার নাম করে ভারতের Alang Yard-কে জাহাজ ভাঙা শিল্প তুলে দিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে ভারত থেকে আমদানি নির্ভর করে পঙ্গু করে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়।
এরপরেও আমাদের একদল সুশীল লীগ সরকারের উন্নয়ন ছাড়া কোন কিছুই চোখে দেখেনা। শেখ হাসিনা কেন বলেছিল, “ভারতকে যা দিয়েছি তা সারা জীবন মনে রাখবে” আবার ভারতও কেন লীগ ছাড়া এই দেশে আর কাউকেই কল্পনা করতে পারেনা তা কি এবার বুঝতে পেরেছেন?
বুঝলে আপনিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সত্যিকারের বাংলাদেশী, আর না বুঝলে আপনি চেতনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভারতের দালাল।