Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এবারের নির্বাচনে ২৮টি পদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের আবু সাদিক কায়েম। নিরঙ্কুশ এই জয়ের নেপথ্যের গল্প এবং নারীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস, শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু, শিক্ষার্থীদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, ডাকসুকে ক্যালেন্ডার ইভেন্টে পরিণত করাসহ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ভবিষ্যৎ নানান পরিকল্পনার কথা তিনি জানিয়েছেন কালবেলাকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমজাদ হোসেন হৃদয়

ডাকসু নির্বাচনে আপনাদের প্যানেলের নিরঙ্কুশ জয় হলো। আপনার অনুভূতি কী?

সাদিক কায়েম: এটি জুলাই প্রজন্মের জয়, শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার জয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জয় হয়েছে। এখানে আসলে কারও পরাজয় বা এককভাবে জেতার বিষয় নেই। আমরা সবাই মিলে জিতেছি। এখন মূল লক্ষ্য হবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। অন্যান্য প্রার্থী যারা নির্বাচন করেছেন, তারাও আমাদের সহযোদ্ধা। আমি ভিপি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে চাই না, আমি তাদের একজন প্রতিনিধি এবং তাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্ন করা, আর আমাদের কাজ হচ্ছে যে কমিটমেন্টগুলো (প্রতিশ্রুতি) করেছি সেগুলো বাস্তবায়ন করা।

নির্বাচিত হওয়ার পর এখন আপনাদের প্রধান লক্ষ্য কী?

সাদিক কায়েম: প্রথম কাজ হচ্ছে, আমাদের দেওয়া কমিটমেন্টগুলো বাস্তবায়ন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশকে শক্তিশালী করা, শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু, শিক্ষার্থীদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিবহন সমস্যার সমাধান, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা জোরদার—এসব নিয়ে আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। হলগুলোর বিশেষ কিছু সমস্যা যেমন—ওয়াশরুমের দুরবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রিডিংরুম ফ্যাসিলিটি এসবের উন্নয়ন হবে অগ্রাধিকারভিত্তিক। মেয়েদের হলের নিরাপত্তা, বাস সার্ভিসে লাইভ লোকেশন চালু, লাইব্রেরির আধুনিকীকরণ—এসব নিয়েও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ডাকসুকে ক্যালেন্ডার ইভেন্টে যুক্ত করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এরই মধ্যে আমরা এটি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছি।

 

প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ও প্যানেলের যারা হেরে গেছেন, তাদের নিয়ে কাজ করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

সাদিক কায়েম: আমি কারও সঙ্গে বিভাজন চাই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবার। এখানে দল, মত, আদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তাই আমরা শুধু তাদের প্রতিনিধি ও নেতা নই। তাদের কমিটমেন্ট বাস্তবায়ন করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। ডোর-টু-ডোর গিয়েছি ভোট চাইতে, আবার যাব প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে। আমি মনে করি, এখানে আসলে হার-জিত নেই। তাই যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের ইশতেহার ও প্রত্যাশাগুলো আমরা আমাদের কাজে যুক্ত করতে চাই। তারা আমাদের উপদেষ্টা হিসেবে পাশে থাকবেন, ভুল হলে সমালোচনা করবেন, গাইড করবেন। একসঙ্গে আমরা একটি সমৃদ্ধ ক্যাম্পাস গড়তে চাই।

ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের একচেটিয়া জয়ের নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে বলে মনে করেন?

সাদিক কায়েম: এখানে আমরা শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়েছি। এটি কোনো এক দিনের বা ২০ দিনের প্রস্তুতি নয়, কিংবা এক মাসের কাজও নয়। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পুরো এক বছর আমরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব সব কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছি। জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা এবং শহীদদের স্বপ্নকে ধারণ করা, সেটিকে সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক রাখা এবং শিক্ষার্থীদের যে কোনো সমস্যা, তা শিক্ষাবিষয়ক হোক, ব্যক্তিগত হোক কিংবা পারিবারিক হোক—এসবের সমাধানে পাশে দাঁড়ানো, আমরা সেই চেষ্টা করেছি। আমাদের নেতৃত্বের গুণাবলি, ব্যক্তিত্ব ও কার্যকর ভূমিকার কারণে শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি আস্থা রেখেছেন। তারা যে ধরনের নেতৃত্ব খুঁজছিলেন, তা আমাদের জোটের মধ্যেই পেয়েছেন। আমাদের সততা, দক্ষতা এবং ইন্টিগ্রিটির কারণেই শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর ভরসা করেছে—আমরা সেই আস্থার প্রতিফলন ঘটাব। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীদের যে কমিটমেন্টগুলো আমরা দিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলেই আমাদের প্রকৃত বিজয় হবে। আর সেই লক্ষ্য পূরণের জন্যই আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি।

নারী শিক্ষার্থীদের ভোট আপনাদের দিকে ঝুঁকেছে—এটা কীভাবে সম্ভব হলো বলে মনে করেন? আর অনেকে বলছেন, আপনাদের বিজয়ের পর স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

সাদিক কায়েম: ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে। নারীর অধিকার, তাদের সুরক্ষা এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি আমরা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দিয়ে আসছিলাম, বিগত সময়ে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে দেওয়া হয়নি। তবে জুলাই বিপ্লবের পর এক বছর ধরে আমাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছি, এ প্রতিশ্রুতি শুধু মুখের কথা নয়। নারীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা পর্যন্ত আমরা থামব না—এটাই আমাদের স্লোগান। আমাদের ইশতেহারে নারীদের নিরাপত্তা ও অধিকারকে কেন্দ্র করে একাধিক দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানে পরিকল্পনা নিয়েছি এবং শিগগির এসবের বাস্তবায়ন শুরু হবে। নারীরা যে নেতৃত্ব চান, সে নেতৃত্ব আমাদের জোটের মধ্যেই তারা খুঁজে পেয়েছেন। তাই তারা আমাদের প্রতি আস্থা রেখেছেন। একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি মাল্টিকালচারাল প্রতিষ্ঠান। এখানে স্বাধীনতা সীমিত করার কোনো সুযোগ নেই। হিজাব পরা শিক্ষার্থীর যেমন অধিকার আছে, তেমনি নন-হিজাব বা আধুনিক পোশাক পরা শিক্ষার্থীরও সমান অধিকার আছে। পোশাকের পছন্দ, ব্যক্তিগত পরিচয় বা প্রতীক নিয়ে কাউকে হেয় করা, হস্তক্ষেপ করা কিংবা কোনো সিম্বলকে অপরাধী করা—এসব একেবারেই চলবে না। যার যে অধিকার, যে চয়েস, যে রুচি—সে তাই করবে এবং তার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

জগন্নাথ হলে আপনারা সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সাদিক কায়েম: ভোট কত পেলাম, কে কোথায় দিল—এসব বড় বিষয় নয়। আমরা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমরা এখানে যখন কাজ করব, তখন আমরা সবাই প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বা কেউ জগন্নাথ হলের, অথবা কে কোন এলাকা থেকে এসেছে কিংবা কোন ডিপার্টমেন্টের—এসব কোনো বিষয় নয়। আসল বিষয় হলো, আমরা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আর আমরা সবাই মিলে আমাদের ক্যাম্পাসকে বিনির্মাণ করব। কোনো হলে বাড়তি সুবিধা দেওয়া বা না দেওয়ার মতো বিভাজন আমরা করব না। মসজিদ, মন্দির, গির্জা—সব জায়গায়ই সমানভাবে কাজ করব। একইভাবে যখন জগন্নাথ হলের কোনো শিক্ষার্থী আক্রমণের শিকার হবেন বা ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সমস্যায় পড়বেন, আমরা সেটা অ্যাড্রেস করব। আবার অন্য কোনো হলের শিক্ষার্থী একই পরিস্থিতিতে পড়লে, সেখানেও আমরা পাশে থাকব। এখানে বিভাজন বা ‘অন্যকরণ’ (Othering) চলতে পারে না। যে কোনো হলের শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়লে আমরা পাশে থাকব। আমাদের পরিচয় একটাই—আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কাজের মাধ্যমেই আমরা আস্থা অর্জন করতে চাই।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সাদিক কায়েম: আপনাকে এবং কালবেলাকেও ধন্যবাদ।