Image description

রাজনীতির মাঠে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি হানাহানিও ছিল। কিন্তু যশোরে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রধান নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে এখানকার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো ও আলী রেজা রাজু। এই তিন বন্ধু ও নেতা নির্বাচনে পরস্পরের মুখোমুখিও হয়েছেন। কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় ছিল মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত।

পরিস্থিতি ইউটার্ন নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এলে। তখন প্রবীণ নেতৃত্বকে হটিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠেন যারা, তাদের মধ্যে ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ বলে কিছু ছিল না। প্রতিপক্ষের বাড়ি-ঘর ও কার্যালয়ে বোমা হামলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা, মিছিল-সমাবেশে আক্রমণ হয়ে ওঠে নৈমিত্তিক। সরকারের মনোরঞ্জনে উদগ্রীব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিউৎসাহী সদস্যরাও রাজনৈতিক ক্যাডারদের পাশাপাশি নগ্নভাবে এই কাজে অংশ নেয়। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী রেজিমকে স্থানীয় রাজনীতিকরা ‘অন্ধকার সময়’ হিসেবে আখ্যা দেন।

এই সময়কালে আগের সৌহার্দ-সম্প্রীতি উবে যায়, নিপীড়ন-নির্যাতনও রেকর্ড ভাঙে। দলীয় সূত্রে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির ৬৮ নেতাকর্মী খুন হন। আহতের সংখ্যা অগণিত। জামায়াতে ইসলামীর দশ নেতাকর্মী নিহত হন। ছাত্র শিবিরের এক নেতা এখনো গুম। পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন অন্তত ৫৫০ জন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ৫৫ নেতাকর্মী।

সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মীর ঘর-বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। বছরের পর বছর তারা বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। জেলাজুড়ে দুই দলের নেতাকর্মীদের আসামি করে গায়েবি মামলা দেওয়া হয় অন্তত দুই হাজার ২০০। এতে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রয়াত নেতা তরিকুল ইসলাম, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান থেকে শুরু করে তৃণমূলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। কোনো কোনো নেতাকর্মী জেল খেটেছেন ২৫-৩০ বার পর্যন্ত।

যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু আমার দেশকে বলেন, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে যশোরে প্রায় দুই হাজার ২০০ ‘গায়েবি’ ও ‘রাজনৈতিক মামলা’ হয়। মামলাগুলোর বেশিরভাগই কথিত নাশকতার। বাদী কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ, অথবা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এমনকি বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা তরিকুল ইসলাম ও জামায়াতের মাস্টার নূরুন্নবী অনেক নাশকতার মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, মৃত্যুর আগে তরিকুল ইসলাম রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখান থেকে স্ট্রেচারে শুইয়ে অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে হাইকোর্টে নিয়ে জামিন প্রার্থনা করা হয়। গুরুতর অসুস্থ শীর্ষ রাজনীতিকের ওপর এমন জুলুম ইতিহাসে বিরল।

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে যশোরাঞ্চলে বিএনপির প্রধান নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের নামে যশোর, ঢাকা ও নড়াইল মিলে সর্বাধিক ৭৮টি মামলা হয় ফ্যাসিস্ট জমানায়। এর মধ্যে কোনো কোনো মামলা দুই থেকে চারটি ভাগে বিভক্ত হওয়ায় মোট সংখ্যা দেড়শ’ ছাড়ায়। এছাড়া দলের বর্তমান জেলা সভাপতি সাবেরুল হক সাবুর নামে ৬৪টি, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকনের নামে ৬০-এর বেশি মামলা হয়। জেলার মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের নামে মামলা হয় ২০ থেকে ৫০টি। এর মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদক মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চুর নামে কথিত ক্রসফায়ারের মামলাও করে পুলিশ।

জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে এক হাজার দু’শয়ের মতো মামলা হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশ’ মামলা আদালত থেকে খারিজ হয়ে গেছে। ‘রাজনৈতিক মামলা’ হিসেবে প্রত্যাহার হয়েছে ৫৭৭টি। শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের এমন কোনো নেতা নেই যার নামে মামলা হয়নি, জেল খাটেননি। দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান, জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল, প্রয়াত আমির মাস্টার নূরুন্নবী, সহকারী সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুসসহ অনেকের নামে ১৫ থেকে ২৫টি পর্যন্ত মামলা হয়।

জেলার পিপি বলছেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় ৫৩০টি ‘রাজনৈতিক মামলা’ প্রত্যাহার হয়েছে। কিছু মামলা ‘ভুয়া’ জেনেও প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিচারিক প্রক্রিয়ায় এসব মামলার আসামিরা খালাস পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। এসব মামলায় শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা আসামি।

টার্গেট কিলিং

যশোর জেলা বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও দলের ঝিকরগাছা উপজেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন নাজমুল ইসলাম। ধনাঢ্য এই তরুণ ব্যবসায়ীকে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার পাশ থেকে অপহরণ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। ১৫ ডিসেম্বর ভোরে তার মরদেহ পাওয়া যায় গাজীপুরের দক্ষিণ শালনা এলাকায় ‘পাকিস্তান গার্মেন্টস’-এর সামনে মহাসড়কের পাশে। তাকে গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়।

নাজমুলের সহধর্মিণী সাবিরা নাজমুল মুন্নি এখন ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুন্নি বলেন, ‘তখনকার সরকারপ্রধানের আক্রোশের শিকার তার স্বামী। সেই সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহালের দাবিতে দেশব্যাপী রোডমার্চ করছিলেন। ২৬-২৭ নভেম্বর ছিল খুলনা অভিমুখী রোডমার্চ। শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার রোডমার্চে কারা কারা যায়, সব নোট করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আমার স্বামী বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীসহ যশোর থেকে খালেদা জিয়ার রোডমার্চে যুক্ত হয়েছিলেন। এর মাত্র ১৭ দিনের মাথায় নাজমুলকে অপহরণ, গুম ও হত্যা করা হয়।’

মুন্নি বলেন, ‘পুলিশের এলিট ফোর্সের একটি গ্রুপ এই অপরাধে জড়িত। সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজনও জড়িত থাকতে পারে। আমরা আজও এই হত্যার বিচার পাইনি। এমনকি মোহাম্মদপুর থানা আমাদের এজাহারটিও নিতে চায়নি। ৩/৪ বার কাটা-ছেঁড়ার পর যে এজাহারটি পুলিশ গ্রহণ করে তাতে সুনির্দিষ্ট কাউকে অভিযুক্তও করতে পারিনি।’

জনপ্রিয় নেতাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার এই হীন কাজের নজির যশোরে আরো রয়েছে। কেশবপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও দলের যশোর জেলা কমিটির সহ-সভাপতি, ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর আবু ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহের উদ্দেশে ওই বছরের ১২ নভেম্বর ঢাকা গিয়েছিলেন। উঠেছিলেন পল্টন এলাকার হোটেল মেট্রোপলিটনে। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় এই নেতাকে হোটেলের নিচ থেকে ১৮ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অপহরণ করে। এর কিছু সময় পর আবু নিজের ভাইপোকে ফোন করে বলেন, ‘আমি এখন রমনা পার্কের কাছে আছি। এরা মনে হয় আমাকে মেরে ফেলবে।’

এর পরদিন দুপুরে কেরানীগঞ্জ চর খেজুরবাগ এলাকায় ‘বেবি সাহেবের ডকইয়ার্ডের’ কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভেসে ওঠে আবুর মরদেহ। নিহত আবুর ভাই মো. আবুল কাশেম এই বিষয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় এজাহার দেন। কিন্তু আবুর হত্যাকারীরা আজও অধরা।

এই মামলাটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কেশবপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবির সুমনসহ পরিবারটির দাবি, সরকারি বাহিনী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ কারণে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) খুনিদের শনাক্ত করতে উদ্যোগী হয়নি।

জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মীও ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ শিকার হন। যশোর শহরের খড়কী এলাকার হাফেজ মোয়াজ্জেমুল হক ওরফে নান্নু হুজুর ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে। ১৯৭১ সালে যশোর নূতন উপশহরে তার বাড়ির পাশে থাকতেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সেই সূত্রে সাঈদীর একাত্তরের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নান্নু ও তার পরিবার-সদস্যরা ভালোই জানতেন।

নান্নুর স্ত্রী-কন্যারা জানান, তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী হওয়ায় ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ শিকার হন তিনি। ওই রাতে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদের পাশ থেকে তাকে কয়েক পুলিশ সদস্য ঘিরে ধরে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দেয়, ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে পেট ও বুকের মাঝখানে। ঘটনার ছয়দিন পর ১১ মে মারা যান নান্নু। তার মরদেহ বিনা গোসলে গভীর রাতে মাটিচাপা দেওয়ার জন্য পুলিশসহ নানা এজেন্সির সদস্যরা চাপাচাপি করতে থাকে। একপর্যায়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভের মুখে তাকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী জানাজার পর দাফন করতে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।

তবে নান্নুকে জামায়াত ছাড়াও বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামও তাদের কর্মী দাবি করে। দল ও সংগঠনগুলো পরিবারটিকে কিছু সহযোগিতাও করেছে। কিন্তু একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি খুবই দুর্দশায় পড়েছে বলে জানান নান্নুর মেয়ে উম্মে সাদিয়া।

খুনের শিকার যত নেতাকর্মী

উল্লিখিত ঘটনাগুলো ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের সময় বিরোধীদের ওপর হত্যা-নিপীড়নের খণ্ডচিত্র। ওই সময়কালে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তো বটেই, যশোরের হাজারো সাধারণ মানুষ জুলুমের শিকার হয়েছেন আওয়ামী সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে।

যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন আমার দেশকে জানান, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে জেলায় তাদের ৬৮ নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নিহত নেতাকর্মীদের তালিকাও তিনি সরবরাহ করেছেন। ওই তালিকায় নাজমুল ইসলাম, আবু বকর আবু ছাড়াও বেশ কয়েকজন সুপরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, যশোর জেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক আবদার ফারুক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ফেরদৌস হোসেন, চৌগাছা উপজেলা কমিটির চার সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম শান্তি, মকবুল হোসেন, ইমান আলী ও আব্দুল খালেক, অভয়নগর উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক, নওয়াপাড়া পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, যুগ্ম-সম্পাদক মিন্টু পাটোয়ারী, বাঘারপাড়া পৌর কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক বদিয়ার রহমান, ঝিকরগাছা উপজেলার সহ-সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলী, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদত হোসেন।

এছাড়া বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের খুন হওয়া নেতাদের মধ্যে যশোর জেলা যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান ধনী, সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান আকুল, শার্শার লক্ষণপুর ইউনিয়ন সভাপতি সলেমান হোসেন, পুটখালী ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক, বেনাপোল ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী, জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি কবির হোসেন পলাশ অন্যতম।

জামায়াতে ইসলামী যশোর জেলা শাখার প্রচার সেক্রেটারি অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন বিশ্বাস আমার দেশকে জানান, নান্নু ছাড়াও হাসিনার শাসনামলে তাদের আরো ৯ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন দলের উপশহর শাখার সেক্রেটারি আব্দুল হাই সিদ্দিকী বুলবুল, রুকন পদমর্যাদার মোস্তফা জামান উজ্জ্বল, ছাত্রশিবিরের এমএম কলেজ শাখার নেতা কামরুল ইসলাম ও মো. হাবিবুল্লাহ। এছাড়া গুম হয়েছেন বেনাপোল পোর্ট থানা শিবিরের সভাপতি রেজওয়ান হোসেন।

জেলা জামায়াতের সহকারী সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুস বলেন, এমএম কলেজের আসাদ হলে শিবিরের দুই নেতাকে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। সেই পৈশাচিক ঘটনায় জড়িতরা আজও বহালতবিয়তে রয়েছে। চৌগাছার দুই ছাত্রশিবির নেতাকে ধরে নিয়ে গুলি করে একটি করে পা অকেজো করে দেয় পুলিশ।

প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে নিপীড়ন

যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু আমার দেশকে বলেন, ‘বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যেহেতু ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের আর ভোটের দরকার ছিল না, তাই বিরোধীদের ওপর যত ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন করা সম্ভব, সবই তারা করেছে। মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর ধর্মবিদ্বেষী বক্তব্যের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচিতেও পুলিশ বিনাউসকানিতে হামলা চালিয়ে অন্তত ৪৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতকিছুর পরও আমাদের নেতাকর্মীরা কক্ষচ্যুত হয়নি। হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে গেছে।’

জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল আমার দেশকে বলেন, ‘যশোরের গডফাদাররা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম, পঙ্গু করেছে। পুলিশ আর আওয়ামী ক্যাডাররা মিলে অসংখ্য বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে।’

আওয়ামী দুঃশাসনের প্রায় গোটা সময় জামায়াতে ইসলামীর জেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত সব কার্যালয় বন্ধ করে দেয় পুলিশ ও শাসক দলের গুণ্ডারা। জামায়াত নেতাকর্মীরা এই সময়কালে গোপনে বিভিন্ন স্থানে মিলিত হয়ে দলীয় কার্যক্রম চালাতেন। কিন্তু খবর পেলেই পুলিশ হানা দিয়ে ‘নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ’ এনে আটকের পর মামলা দিত।

তবে বিএনপির কোনো কার্যালয় বন্ধ হয়নি জানিয়ে দলটির নেতারা বলেন, অফিস খোলা ছিল। তবে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে গেলেই পুলিশ হানা দিত, সরকারি দলের পাণ্ডারা হামলা করত।

বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের কোনো অফিস বেদখল হয়নি। তবে দল দুটির বহু নেতাকর্মীর ব্যবসা, জমি, মাছের ঘের, ফলের বাগান দখল করে নিয়েছিল আওয়ামী ক্যাডাররা। ৫ আগস্টের পর সেসব সম্পদ-সম্পত্তি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। কোথাও কোথাও সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে বিশেষত বিএনপি নেতাকর্মীরা দলীয় শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন। দলটির নেতারা বলছেন, বেদখল হওয়া সম্পত্তি পুলিশ বা আদালতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে। বলপ্রয়োগ করা যাবে না।

দলীয়ভাবেই হয়রানিমূলক এসব মামলা মোকাবিলা করা হয়েছে বলে জানান বিএনপি ও জামায়াত নেতারা।

তুলনামূলক ছোট দল হলেও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদকে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন যশোরের নাগরিকরা। এই নেতা ও তার কর্মীরা ভবদহ আন্দোলন ও রোডমার্চ করতে গিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন। আওয়ামী ক্যাডার ও পুলিশ মিলে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল দাবি করে জাহিদ বলেন, দুর্বৃত্তদের অন্তর্কোন্দলের কারণে তিনি রেহাই পান।

নেতাদের বাড়ি, দলীয় অফিসে বোমা হামলা

গোটা আওয়ামী শাসনামলে যশোরে নির্বাচন অথবা বিএনপির কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি থাকলে তার আগের রাতে নেতাদের বাড়ি বাড়ি ও পার্টি অফিসে বোমা হামলা হতো। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনীর সঙ্গে এসব হামলায় অংশ নিতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অতিউৎসাহী সদস্যও। দলের স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সদস্য তরিকুল ইসলাম ও পরে তার ছেলে কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, সাবেক মেয়র মারুফুল ইসলাম, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, গুরুত্বপূর্ণ নেতা মিজানুর রহমান খান, গোলাম রেজা দুলু, হাজি আনিছুর রহমান মুকুলের বাড়ি ছাড়াও শহরের প্রধান সংগঠকদের বাসভবনে বহুবার বোমা হামলা হয়েছে। ওই ঘটনাগুলোর কোনোটির ব্যাপারে মামলা হয়নি, ধরা পড়েনি দুর্বৃত্তরা। যদিও সবাই জানে কারা এসব ঘটনা ঘটাত। দলটির নেতাদের কথায়, বোমা হামলার ঘটনায় কয়েকবার থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ মামলা হিসেবে রেকর্ড করেনি। ফ্যাসিবাদী জমানায় এসব অপরাধের বিচারের আশাও তারা করেননি।

আওয়ামী শাসনামলে জামায়াতের যশোর জেলা কার্যালয় ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের বেশ কয়েকটি কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়েছে। অফিসের কক্ষ তছনছ করেছে পুলিশ।

জঙ্গি নাটক

তথাকথিত ওয়ার অন টেররের যুগে সারা দেশের মতো যশোরেও ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালাত পুলিশ। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর পালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যশোরের এসপি থাকাকালে প্রায়ই ‘জঙ্গি নাটকগুলো’ মঞ্চায়িত হতো। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর যশোর এমএম কলেজের পুরোনো ছাত্রাবাস মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর মূল সড়ক থেকে ধরে নিয়ে ইমাম মাওলানা মোজাফফর হোসেনকে শহরতলির পাগলাদহ এলাকায় তার নিজ বাড়িতে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজানো হয়। দীর্ঘদিন জেলে থেকে ছারখার হয়ে যায় মোজাফফরের জীবন।

শহরের ঘোপ এলাকার একটি বাড়িতে এমনই একটি জঙ্গি নাটক সাজানো হয় সে সময়। ওই বাড়িটি ঘিরে ফেলে বাইরে থেকে এসপি হ্যান্ডমাইকে ক্রমাগত বলতে থাকেন, ‘ঘরের মধ্যে নারী-শিশুরা থাকলে বেরিয়ে আসেন। তা না হলে পুলিশ অভিযান চালালে আপনারা মারা পড়তে পারেন।’ একপর্যায়ে পুলিশ ওই বাড়ির নির্দিষ্ট ঘরের দরজা ভেঙে এক তরুণী গৃহবধূ ও তার শিশু সন্তানকে ধরে এনে ‘অভিযান’ শেষ করে। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে ওই নারী এক সংবাদকর্মীর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দরজায় বাইরে থেকে তালা আটকে বের হতে বললে আমি কিভাবে বের হব?’

শহরের পুরাতন কসবা বিবি রোড, শহরতলীর খোলাডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরীহ মানুষের জীবন তছনছ করে দেন এসপি আনিস। প্রায় চার বছর যশোরে দায়িত্ব পালনকালে এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারে হত্যা, নাশকতা মামলায় আসামি বানানোসহ নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যশোরে যোগদানের একদিন পর তিনি সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘‘জামায়াত-শিবিরের অবস্থান হবে হয় জেলে না হয় কবরে। আর নিয়মিত ‘ফুল ডাউন’ ও ‘হাফ ডাউন’ চলবে।” ফুল ডাউন বলতে তিনি হত্যা আর হাফ ডাউন বলতে গুলি করে অঙ্গহানি করাকে বোঝাতেন। এসপি আনিস অবশ্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকেও ‘হাফ ডাউন’ করেন। এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তার বিবাদ ছিল প্রকাশ্য।

আনিসের বিদায়ের পর এসপি প্রলয় কুমার জোয়ারদারের সময়ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ভীষণ নিপীড়িত হন। এই কর্মকর্তাও হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পালিয়ে যান।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ২৭

এদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সরকারি হিসাবে যশোরে শহীদের সংখ্যা ২৭। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠিত স্বাস্থ্য সেলের সক্রিয় কর্মী ও নিহত পরিবারগুলোর সেবায় নিবেদিত মেজবাউর রহমান রামিমও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। শহীদদের মধ্যে তিনজন রাজধানীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। অন্যরা যশোরের গডফাদার শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন ফাইভ স্টার হোটেল জাবিরে দেওয়া আগুনে মারা যান। শহীদদের মধ্যে ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির, তৌহিদুর রহমান রানা, সাকিবুল হাসান মাহি, তানভীর রায়হান আলিফ, ইউসুফ আলী, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, মো. আল-আমিন হোসেন এবং ফরহাদ ফাইয়াজকে বিএনপি তাদের কর্মী বলে দাবি করে। তবে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহকে শিবিরের নেতা হিসেবে দাবি করে জামায়াতে ইসলামী।

শীর্ষ রাজনীতিকদের ভাষ্য

সামগ্রিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত আমার দেশকে বলেন, ‘বিরুদ্ধ মত দমনের কৌশলের অংশ হিসেবে হাসিনার ক্যাডার ও প্রশাসনের অতিউৎসাহী সদস্যরা আমাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। টার্গেট কিলিং করা হয়েছে জনপ্রিয় নেতাদের। এমনকি বেনাপোলে একটি বাসাবাড়ির তিন তলার ছাদে মিলাদে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের নিচে ছুড়ে ফেলে যুবলীগের চিহ্নিত ক্যাডাররা। ওই ঘটনায় আহত স্থানীয় নেতা আব্দুল আলিম ২৮ দিন চিকিৎসার পর মারা যান। আহতরা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি।’

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট রেজিম ছিল অত্যাচারী শাসকের আমল। সারা দেশের মতো যশোরেও ওই সময়কালে আইন, নিয়ম-নীতির বালাই ছিল না। পুলিশ যে কত নৃশংস হতে পারে এসপি আনিসুর রহমানের সময় থেকে আমরা দেখেছি। তারই ধারাবাহিকতা চলেছে পরবর্তী সময়ে।’

বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ আমার দেশকে বলেন, ওই সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্র-সমাজের কর্তৃত্বে ছিল দুর্বৃত্তরা। ফলে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল অসহনীয়, উৎকণ্ঠায় ভরা। এমনকি গ্রামের কোনো হাট-বাজারে সভা করতে গেলেও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কৈফিয়ত তলব করত। অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য দখল ও রাজনৈতিক কারণে তারা মেতে উঠেছিল খুন-খারাবিতে।