
ফেসবুকে ‘টু-লেট’ বিজ্ঞাপন দেখে বাসা খুঁজতে গিয়ে ময়মনসিংহ শহরে এক অভিনব প্রতারণার শিকার হয়েছেন আনন্দমোহন কলেজের এক শিক্ষার্থী। এই ঘটনায় পুলিশ দ্রুত দুই তরুণীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের রিমান্ডের আবেদন করেছে। তবে ঘটনার তদন্তে একটি নতুন মোড় এসেছে। প্রতারণার শিকার হওয়া ভুক্তভোগী কলেজছাত্র নিজেই অতীতে একটি মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর থেকেই ঘটনাটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
প্রতারণার ফাঁদ এবং ঘটনার সূত্রপাত
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, নাজমুল হাসান ওরফে নাঈম (২৩), আনন্দমোহন কলেজের গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায়। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ শহরের একটি মেসে থাকেন। সম্প্রতি ট্রেনের শব্দে পড়াশোনার সমস্যা হওয়ায় তিনি নতুন বাসা খুঁজছিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) তিনি একটি ফেসবুক গ্রুপে সাবলেট ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে ময়মনসিংহ নগরের গুলকিবাড়ী এলাকার ফখরুজ্জামান টাওয়ারে বাসা দেখতে যান।
নাজমুল জানান, ওই বাসায় যাওয়ার পর তাকে চার তরুণী ও চার তরুণ মিলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এরপর তাকে মারধর করা হয় এবং তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং নগদ ২৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। চক্রটি তাকে হুমকি দিয়ে একটি লিখিত মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে যে, তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলেন। এরপর তাকে অস্ত্রের মুখে এটিএম বুথে নিয়ে গিয়ে আরও ২০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয় এবং কাউকে কিছু জানালে ক্ষতির হুমকি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পুলিশি অভিযান ও দুই তরুণীর গ্রেপ্তার
ভুক্তভোগী নাজমুল হাসান শুক্রবার ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ দ্রুত অভিযান চালায় এবং চক্রের দুই নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন সাদিয়া জাহান ওরফে মেঘলা (২১) এবং ফারিয়া আক্তার ওরফে পায়েল (১৯)। দুজনেরই বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে নাজমুলের খোয়ানো মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ উদ্ধার করে।
কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শিবিরুল ইসলাম জানান, এই চক্রটি পরিকল্পিতভাবে কাজ করে। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে ‘টু-লেট’ বিজ্ঞাপন দিয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেদের আকৃষ্ট করে। এরপর তাদের জিম্মি করে আপত্তিকর ছবি তুলে এবং মারধর করে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেয়। তিনি আরও জানান, গ্রেপ্তারকৃত দুই তরুণী প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে এবং এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত রয়েছে। পুলিশ তাদেরকেও গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছে।
বিলাসী জীবন এবং প্রশ্ন ফাঁসের যোগসূত্র
গ্রেপ্তারের পর থেকেই সাদিয়া ও ফারিয়ার বিলাসী জীবনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তাদের জীবনযাত্রা পরিবারের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে পুলিশের ধারণা। এই বিলাসী জীবনের অর্থের উৎস কী, তা জানতে পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। শনিবার গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য আদায়ের জন্য পুলিশ রোববার পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে।
তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি প্রকাশ পায় যখন ভুক্তভোগী নাজমুল হাসানের অতীতের একটি ঘটনা সামনে আসে। জানা গেছে, তিনি নিজেও চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য হিসেবে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, নাজমুল ভুয়া প্রশ্নপত্রের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতেন। এই বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই নাজমুল তার মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুব আলম ফকির জানান, তারা এই নতুন তথ্যটি সম্পর্কে আগে অবগত ছিলেন না। তিনি বলেন, এখন তারা প্রতারণার ঘটনাটির পাশাপাশি বাদীর অতীত অপরাধের বিষয়টিও ভালোভাবে তদন্ত করে দেখছেন। এই ঘটনার সঙ্গে আরও কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশের তদন্তে এই চক্রের সব সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং ঘটনার পেছনের সব রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে।