
ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রামাণ্যচিত্র
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে বলে দাবি করেছে ব্রিটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমস। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে এ তথ্য উঠে আসে। ডকুমেন্টারির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের হারানো বিলিয়নস: চোখের সামনেই লুট।‘
প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, অর্থ পাচারের জন্য বাণিজ্যে অতিরিক্ত বা কম ইনভয়েসিং, হুন্ডি ও হাওয়ালা চক্র এবং যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনাবেচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। লন্ডনকে মূল গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিস্তৃত আর্থিক খাত ও লাভজনক সম্পত্তি বাজার এই অর্থ পাচারের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ছিল।
ডকুমেন্টারিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার অভিযোগ উঠে এসেছে। এছাড়া ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের নামও অর্থপাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। জন রিড জানান, এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বন্দুকের মুখে ব্যাংকের পরিচালককে অপহরণ করে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং শেয়ার শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠদের কাছে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে বাধ্য করেছেন।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক খান বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি কোনো গোপন বিষয় ছিল না। তিনি আরও জানান, অনেক কিছু যেন চলচ্চিত্রের গল্পের মতো ছিল। তাঁর কয়েকজন বন্ধু কুখ্যাত কারাগার (হল অব মিররস) আয়না ঘরে বন্দি ছিলেন, যেখানে বন্দিদের শুধু নিজেকেই দেখা যেত। তিনি উল্লেখ করেন, গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ঘনিষ্ঠরা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিত।
প্রামাণ্যচিত্রে ফিনান্সিয়াল টাইমসের সংবাদদাতা সুজানাহ স্যাভেজ বলেন, স্বৈরতন্ত্র ও ব্যাপক দুর্নীতি শুধু দূরদেশে ঘটে এমন ধারণা ভুল। যুক্তরাজ্যও এর কেন্দ্রবিন্দু। তবে লুট হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। অনেক সময় অর্থপাচারকারীদের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা করতে হয়। এতে প্রশ্ন আসে, কতটুকু অর্থ ফেরত আনা সম্ভব এবং তা জনগণের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ পুনরুদ্ধার টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ইফতি ইসলাম বলেন, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল প্রক্রিয়াগুলোর একটি। তিনি জানান, ব্যাংক ও ব্যবসা খাত থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লোপাট হয়েছে, যা সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে কোনো দেশের সবচেয়ে বড় অর্থপাচার। তিনি আরও বলেন, যতটা সম্ভব সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ, লেনদেনের ধারা অনুসরণ এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন।
জন রিড মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের বিপ্লব একটি মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত হলেও ভবিষ্যতে আবারও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা একদল মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে। অধ্যাপক মোশতাক খান বলেন, যে মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো সামনে এসেছে, সেগুলোর সংস্কার অপরিহার্য। যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, এই সংস্কার আটকানো সম্ভব হবে না।
প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ হয় ছাত্রনেত্রী রাফিয়া রেহনুমা হৃদির বক্তব্য দিয়ে, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবো না।‘