Image description

সংবিধান সংশোধনে গণভোট চায় দেশের ৮১ শতাংশ মানুষ। ৮৩ শতাংশ মনে করে, প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি থাকা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ সমর্থন করেন ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জনমানুষের ভাবনা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজিং ইনস্টিটিউট (বিইআই) গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ: জনমানুষের ভাবনা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোল টেবিল আলোচনায় এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।

বিইআই সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি কোনো আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল একটি অভ্যুত্থান বা বিপ্লব। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে দেখতে চাইছে। বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছে দেশ। গণতান্ত্রিক উত্তরণ মানে শুধু একটি নির্বাচন নয়। তারা আরো বলেন, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে না পারলে কেবল নির্বাচন দিয়ে দেশের কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন আসবে না। সংস্কার প্রশ্নে জুলাই বিপ্লবের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনে আরো আলাপ-আলোচনার জন্য ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা জরুরি।

গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দার, সাবেক রাষ্ট্রদূত শফিউল্লাহ, সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান, অ্যাডভোকেট রোকসানা খন্দকার।

অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির সহ-সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) হেলাল উদ্দিন আহমেদ, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা, বাংলাদেশ জাসদের ড. মুশতাক হোসেন, নাগরিক ঐক্যের সাকিব আনোয়ার, এনডিএমের মহাসচিব মোমিনুল আমিন প্রমুখ।

গোলটেবিল আলোচনায় গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বিইআই’র উপ-পরিচালক চৌধুরী সামিউল হক বলেন, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের ১২টি জেলায় পরিচালিত এই গবেষণায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী, নারী ও যুব সমাজের প্রতিনিধিসহ ১৫শ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সংস্কার কার্যক্রম, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার, সুষ্ঠু নির্বাচন, সংবিধানের সমসাময়িকীকরণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত দিয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রশাসনিক সংস্কার ও দুর্নীতি দমনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের পক্ষে মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষ মতামত দিয়েছে। শুধু সংস্কার চায় ১৯ শতাংশ। তবে সংস্কার এবং নির্বাচনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৫৭ শতাংশ মানুষ। ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ চায় ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ, সংবিধান সংশোধনে গণভোট চায় ৮১ শতাংশ এবং সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে ৮৩ শতাংশ মানুষ।

নির্বাচন সংস্কারের ব্যাপারে ব্যালটে ‘না’ ভোট রাখার বিধানের পক্ষে ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশ, প্রার্থীদের আয়-ব্যয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ৭৮ শতাংশ এবং নারী প্রতিনিধিত্বে সরাসরি ভোটের পক্ষে মত দিয়েছে ৯১ শতাংশ মানুষ। স্থানীয় সরকারের বেলায় দলনিরপেক্ষ নির্বাচন চায় ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশ, এমপিদের হস্তক্ষেপ বন্ধের পক্ষে ৮৭ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে মতামত এসেছে ৮৩ শতাংশ মানুষের।

রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মত দিয়েছে ৯৬ শতাংশ, দলের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার পক্ষে ৯৪ শতাংশ এবং দলের কাঠামোতে নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পক্ষে মতামত দিয়েছে ৭৬ শতাংশ মানুষ।

বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের চাহিদা ও সমস্যাগুলোর প্রতি কতটা মনোযোগ দিচ্ছে—এমন প্রশ্নে মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ বলেছে দলগুলো যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে। ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, দলগুলো জনগণের ব্যাপারে একদমই মনোযোগ দিচ্ছে না, কিছুটা মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করে ৫৪ শতাংশ মানুষ।

ড. আলী রীয়াজ প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, আমরা সবাই এখন গণতন্ত্রের উত্তরণ চাইছি। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে গণতন্ত্রে উত্তরণ মানে নির্বাচন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। আমাদের দেশে ৯০ সালের পরে অন্তত তিনটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেনি। গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটাতে হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের ওপর পা রেখে ‘এক নেতার এক দেশ’ পদ্ধতি চালু করা হয়। ২০০৯ সালে এসে আবার শেখ হাসিনা ঠিক একই কাজ করেছেন। তিনি কোনো বিরোধী দল রাখেননি। যারা মনে করছেন, আগামীতে একটি নির্বাচন হলেই দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে, তারা অবশ্যই ভুলের মধ্যে রয়েছেন। আগামীর নির্বাচন হতে হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্বাচন।

সালাহউদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের সামনে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। আমাদের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমেই বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হবে। তিনি বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়া সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই সম্পন্ন করা সম্ভব। রাতারাতি কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না আনলে আবার পুরনো ব্যবস্থা ফিরে আসবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ থাকবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য যেন বজায় থাকে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সবাই গণতান্ত্রিক উত্তরণের কথা বলছে। কিন্তু স্বৈরাচার যাতে আর কখনো ফিরে আসতে না পারে, সে ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব চোখে পড়ছে। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যা দেখছি, তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। দলগুলো ছাত্র এবং শিক্ষকদের তাদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছে। ছাত্রদের কাজ লেখাপড়া করা এবং শিক্ষকদের কাজ শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু তারা তাদের মূল কাজ বাদ দিয়ে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রীতিমতো কলুষিত করছে।

ডা. তাসনিম জারা বলেন, জুলাই বিপ্লবকে অনেকে বিপ্লব বলতে চান না। বিপ্লবে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর অপচেষ্টা হচ্ছে। গত এক বছর ধরে আমরা এটা লক্ষ্য করছি। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশের মানুষ। সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না তারা।

সভাপতির বক্তৃতায় রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশে এক নতুন প্রজন্মের উত্থান ঘটেছে। তারা দেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তারা গতানুগতিক ব্যবস্থার বাইরে নতুন করে ভাবছে। তিনি বলেন, আমরা এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সবার মাঝে পারস্পরিক ঐক্য ও সহনশীলতা জরুরি।