
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ এবং মাধ্যমিকের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আছে বিস্তারিত বর্ণনা। এর পরও অযৌক্তিকভাবে অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই ‘সাহিত্য-কণিকা’য় বহাল রাখার চেষ্টা হচ্ছে এ ভাষণ।
বাংলা সাহিত্যে ভাষণটি রাখার প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও পাঠ্যপুস্তকে মুজিবীকরণের আগের সে প্রক্রিয়া এখনো বহাল থাকছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন পরিচালিত পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন-সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনেও বাংলা বইয়ে এ ভাষণ রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে জানানো হয়।
তারপরও একটি প্রভাবশালী মহল পাঠ্যপুস্তকে মুজিবীকরণের এ ধারা বহাল রাখার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। আগামীকাল সোমবার অনুষ্ঠেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। শিক্ষাবিদ ও অংশীজনদের দাবি, বাংলা সাহিত্যসহ সব শ্রেণির বইয়ে মুজিবের ভাষণসংশ্লিষ্ট বিষয় রাখার প্রয়োজন নেই।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তৃতীয় থেকে নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে ইতিহাসের আলোচনায় ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। এছাড়া মাধ্যমিকের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়েও ইতিহাসের আলোচনায় এ বিষয়ে বর্ণনা আছে। এর বাইরেও অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই ‘সাহিত্য-কণিকা’য় ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শিরোনামে ৩১ থেকে ৩৬ পৃষ্ঠায় হুবহু ভাষণটি রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভাষণটির লেখক পরিচিতি হিসেবেও মুজিবুরের নাম রাখা এবং তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’।
এছাড়া একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের (ইংলিশ ফর টুডে) চতুর্থ অধ্যায়ে ‘থ্রি স্পিসেস’ নাম দিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ রাখা হয়েছে। অথচ সাহিত্যের আলোচনায় এ ভাষণ থাকার প্রাসঙ্গিকতা নেই। এরই মধ্যে এ বই থেকে মুজিবের ভাষণ বাদ দেওয়ার বিষয়ে মত এসেছে।
এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহসানুল হক মিলন আমার দেশকে বলেন, মুজিবের ভাষণ কোনো উপন্যাস নয় যে, এটি বাংলা সাহিত্য বইয়ে রাখতে হবে। বিষয়টি যে কোনো একটি ক্লাসের একটি বইয়ে থাকলেই যথেষ্ট। একই বিষয় একাধিক ক্লাসে বারবার পড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আর বাংলা সাহিত্যে এ বিষয় রাখার তো কোনো প্রয়োজনই নেই।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাস বইয়ে থাকতেই পারে। আওয়ামী বয়ানের অংশ হিসেবে এ ভাষণ কোনোভাবেই সাহিত্যে থাকতে পারে না। মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে যদি সাহিত্যে রাখা হয়, তাহলে কেন স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার ১৯ দফা সাহিত্যে থাকবে না? আমি শহীদ জিয়ার ঘোষণা ও রাষ্ট্র গঠনের ১৯ দফাও সাহিত্যে যুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ‘পাঠ্যপুস্তকের ভুল চিহ্নিতকরণ ও পরিমার্জন’ প্রতিবেদনে অষ্টম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বই এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজি বই থেকে ৭ মার্চের ভাষণ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশে ইতিহাসসংশ্লিষ্ট বইয়ে ভাষণটি থাকার পরও সাহিত্য বইয়ে রাখলে বিতর্ক হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়।
আরো জানা গেছে, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যবই এবার কয়েক ধাপে পরিমার্জন করেছে এনসিটিবি। সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক পরিমার্জন ছাড়াও পাঠ্যপুস্তক নির্ভুল করতে এবং বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো বাদ দিতে ভূমিকা রাখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তর।
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তকগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদন ও স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত ১৮ আগস্ট এনসিটিবি কার্যালয়ে এনসিসিসির সভা হয়। সভায় উপস্থিত একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের বইগুলোর অনুমোদন দেওয়া হলেও অষ্টম শ্রেণির ‘সাহিত্য-কণিকা’ বইয়ে থাকা ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও আপত্তি ওঠে। সভায় যারা মতামত ব্যক্ত করেন এর মধ্যে একজন (একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক) ছাড়া সবাই মুজিবের ভাষণ সাহিত্য বইয়ে রাখার দরকার নেই বলে মতামত দেন। বেশিরভাগ সদস্যের তীব্র আপত্তির মুখেও ওই সদস্য এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে বৈঠকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়েও ৭ মার্চের ভাষণ সংক্ষেপ করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় অংশ নেওয়া এক সদস্য বলেন, ৭ মার্চের পুরো ভাষণে কিছু বিতর্কও রয়েছে। তারপরও ঐতিহাসিক আলোচনায় ভাষণটি ইতিহাসের বইয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সাহিত্য বইয়ে এ ভাষণ থাকার যৌক্তিকতা নেই। পাঠ্যবইকে মুজিবীকরণ এবং আওয়ামী বয়ান প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার নেওয়া পলিসি এখনো অনুসরণ করা খুবই অপ্রত্যাশিত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সাহিত্য বইয়ে ভাষণটি রাখতে অনেক দিন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি ও এনসিটিবির মধ্যে দৌড়ঝাঁপ চলে। সাবেক শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এ ভাষণ রাখার পক্ষে এবং সময়স্বল্পতার অজুহাতে জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে যুক্ত না করতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ওই সচিব এখন না থাকলেও এখনো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের কেউ কেউ এ ভাষণ রাখার পক্ষে ভূমিকা রাখছেন।
সূত্রে আরো জানা যায়, সাহিত্য বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ থাকলে সমালোচনার শঙ্কায় জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির চার সদস্য নিয়ে ভাষণটির সংক্ষেপিত অংশ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির প্রভাবশালী একটি অংশ। তবে ওই কমিটির একাধিক সদস্য ৭ মার্চের ভাষণের সংক্ষেপিত ভার্সন নিয়ে মতামত দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এনসিসিসি কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, সোমবার (আগামীকাল) একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। জাতি ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নিয়ে আমরা সচেতন।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরীর মোবাইলে যোগাযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর বলেন, আমরা বাংলা সাহিত্যে মুজিবের ভাষণ বাদ দেওয়ার পক্ষে। সোমবার এনসিসিসির একটি মিটিং হবে। সেখানে ওই ভাষণের বিকল্প একটি বিষয় (ছোটগল্প) রেডি করেছি। সেটি প্রস্তাব করা হবে। অনুমোদন হলেই মুজিবের ভাষণ বাদ দিয়ে সেটি রাখা হবে।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীনের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তা রিসিভ হয়নি।