
কার্বন নিঃসরণ কমাতে সড়ক ও রেলপথে দুইটি নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সরকার। একটিতে গ্রিন রেলওয়ে প্রকল্প, অন্যটি ঢাকার সড়কে বৈদ্যুতিক বাস বাস্তবায়ন। দুই
ব্যবস্থারই গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পরিবেশ সংরক্ষণ। অর্থাৎ পরিবহন খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানো। বৈদ্যুতিক বাস বাস্তবায়ন বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্টের আওতায় বাস্তবায়িত হবে। অন্যদিকে গ্রিন রেলওয়ে বাস্তবায়িত হবে গ্রিন রেলওয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। তবে, দুইটি প্রকল্পই ধীরগতিতে চলছে। একটি আটকে আছে পরিকল্পনা পর্যন্ত, অন্যটি অর্থায়ন চুক্তিতে।
দেশের আন্তঃজেলা পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অনেকাংশেই সড়কপথের ওপর নির্ভরশীল। বন্দরগুলো ৯৬ শতাংশ পণ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় যায় সড়কপথে। বাকি মাত্র ৪ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় রেল ও নৌপথে। ফলে সড়ক পথে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়ছে। এতে পরিবেশ দূষণও হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। অন্যদিকে, দেশের সড়কগুলোতে প্রায় সকল যাত্রীবাহী বাসই ডিজেল কিংবা অন্যান্য জ্বালানিতে চলে। কালো ধোঁয়াসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয় এসব যানবাহনের ধোঁয়া থেকে। যাতে থাকে বিষাক্ত কার্বন। গ্রিন রেলওয়ে এবং ঢাকার সড়কে বৈদ্যুতিক বাস বাস্তবায়িত হলে অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নির্গমন কমে আসবে বলে জানিয়েছে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
গুরুত্বপূর্ণ এই দুটো উদ্যোগের বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হতে দীর্ঘসূত্রতায় গড়াচ্ছে। জটিলতা দেখা দিচ্ছে শুরু হতে। গত ১লা জুলাই থেকে ঢাকার সড়কে ইলেকট্রিক বাস আসার কথা থাকলেও তা এখনো ওঠেনি জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সভায়। এখনো চলছে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন পাস হয়ে গেলেও বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্টের বৈদ্যুতিক বাস নামানোর প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। একনেক গত মাসের ২৭ তারিখ তাদের সভা করে। সেখানে ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়সম্বলিত ১২টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ছিল না ইলেকট্রিক বাস প্রকল্প। সংশ্লিষ্টসূত্র জানিয়েছে, ইলেক্ট্রিক বাস বাস্তবায়ন হলে সরকারকে ক্যাপিটাল সাবসিডি দিতে হতে পারে। তবে অর্থনৈতিকভাবে সরকার লাভবান হবে। অর্থাৎ বৈদ্যুতিক বাস সড়কে নামলে সেটি পরিচালনা করলে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি সরকারকে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। বাস যে সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন তাদের ক্ষতি হওয়ার সুযোগ থাকবে না। বাস অপারেটরদের সরকার তাদের সক্ষমতা ও পার কিলোমিটার অনুযায়ী টাকা দেবেন। এ সকল বাসের অপারেটররা কী পরিমাণ যাত্রী বাসে পরিবহন করছে তার ওপর ভিত্তি করে কার্যক্ষমতা নির্ধারিত হবে না। যেহেতু বাস পরিচালনাকারীদের লাভ বা ক্ষতির বিষয়ে ভাবতে হচ্ছে না, ক্ষতি হলে সেটি সরকারকে দেখতে হবে।
ওদিকে পরিবেশবান্ধব গ্রিন রেল পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে ৯৩ কোটি ৫১ লাখ টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে গত ২০শে এপ্রিল অনুমোদিত হয়। অনুমোদিত বাস্তবায়ন মেয়াদ ১লা এপ্রিল ২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত। একনেকে অনুমোদনের পর গত ১৫ই জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ৩ শাখার উপ-সচিবের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদনের কথাও জানানো হয়। তবে, গ্রিন রেলওয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই শীর্ষক এই প্রকল্পেরও কাজও শুরু হয়নি এখনো। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে যে ঋণ পাওয়ার কথা ছিল সেটির বিষয়ে বেশ কিছু দিন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি সরকার। সূত্রমতে, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সেখানে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংক একমত হলে সরকার আবার চিঠি পাঠায়। এই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য কী পরিমাণ সুদ সরকারকে দিতে হবে এবং সুদের হার যাতে কম হয় সে বিষয়ে সম্প্রতি ইকোনমিক রিলেশন ডিভিশনে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে। লোনের বিষয়ে ঐকমত্য হতে দেরি হচ্ছে, সে জন্য প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ঐকমত্যে না পৌঁছানোর জন্য প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ, দরপত্র দেয়াসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজগুলো করা যাচ্ছিলো না। গত সপ্তাহে সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি চূড়ান্ত হলে দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, গ্রিন রেলওয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে করা একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের ডিটেইল ডিজাইনে হবে বাংলাদেশে রেলওয়ের কমলাপুর রেলস্টেশন এবং বিমান বন্দর রেলস্টেশনে মাল্টিমোডাল হাব। এ প্রকল্প ২০৪৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। এয়ারপোর্ট ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে রিমডেলিং করতে হবে। নতুনভাবে মডেলিং হবে বিধায় কমলাপুর রেলস্টেশন ভাঙা লাগতে পারে। কমলাপুর রেলস্টেশনের ভবনটি একটি বিশাল প্লাজা হবে। সেখানে মানুষজন ঘুরতে পারবে। গ্রিন রেলওয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরমান হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমরা যে প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছি, এখানে কাজগুলো মূলত লজিস্টিকবেজড। অর্থাৎ যাতে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি পায়। সাধারণত পণ্য পরিবহন করা হয় ট্রাকে। কিন্তু একটি ট্রেনে অন্তত ৬৪টি কন্টেইনার পরিবহন করা সম্ভব। ৬৪টি কন্টেইনার পরিবহনের জন্য ৬৪টি ট্রাকের প্রয়োজন। আর ট্রেনের মাধ্যমে কন্টেইনার পরিবহন করলে একসঙ্গে ন্যূনতম ৬৪টি কন্টেইনার পরিবহন সম্ভব। একটি ট্রেনে আমরা যে পরিমাণ কার্বন পোড়াবো তাতে ৬৪টি ট্রাক্টরের কার্বনে অনেক বেশি কার্বন পোড়াতে হবে। দূষণও অনেক বেশি হবে। এজন্য এটি উল্লেখযোগ্যহারে কার্বন নিঃসরণ কমাবে।