Image description

গত বছরের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনার পর পুলিশের সংস্কারের বিষয়টি সামনে এসেছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি সামনে এসেছে। পাশাপাশি বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি পুলিশ কমিশন গঠন করে কমিশনের অধীনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারাও চান পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি কমিশনের অধীনেই হোক। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারাও পুলিশ কমিশন গঠনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

তবে অভ্যুত্থানের পর গত ১৪ মাসেও পুলিশ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমান সরকার পুলিশের সংস্কারের অংশ হিসেবে নানা পদক্ষেপ নিলেও এখনো কমিশন গঠন করেনি। তবে শিগিগরই কমিশন গঠন হবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে। জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে আমি শতভাগ সন্তুষ্ট না।’

পুলিশের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় এক শ্রেণির দলবাজ, লাইনবাজ, ঘুষঘোর পুলিশ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য হয়েছে। ঐ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। তারা বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে আর ব্যবহূত হতে চাই না। এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। প্রতিষ্ঠিত নিরপেক্ষ বডি কিংবা কমিশনের মাধ্যমে পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি দেওয়া হলে জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী হবে এবং দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ থাকবে না বলে তারা মনে করেন।’

মহাসড়ক ধরে ৬০ কিমি গিয়েও দেখা মেলেনি পুলিশের :গত ২৩ অক্টোবর এ প্রতিবেদক রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভার থেকে রওনা দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির গৌরীপুর পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার গিয়েও সড়কে পুলিশের টহল দেখতে পাননি। রাত ১২টার পর গৌরীপুর থেকে কচুয়া সড়কের দিকেও কোনো টহল পুলিশ দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সড়কের দুই/এক জায়গায় টহল রয়েছে। অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েক দিন এ সড়কে রাতে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এর এক দিন আগে মধ্যরাতে এ প্রতিবেদক হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে পদ্মা সেতুর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত যান। সেখান থেকে পুনরায় ঢাকায় ফিরে এলেও কোথাও পুলিশের টহল দেখতে পাননি। তবে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় রাতে পুলিশের টহল থাকলেও ঢাকার বাইরে প্রায় সব জেলায় একই অবস্থা। একাধিক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসে সারা দেশে পুলিশের ওপর ৫৯৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব কারণে সাধারণত রাতের বেলায় রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশের টহল চোখে পড়ে না। তবে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় রাতে টহল থাকে বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

‘পুলিশ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন’ :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। পুলিশের ওপর হামলা, থানা থেকে আসামি ছিনতাই, মব ঠেকাতে গিয়ে ওসি বদলি অর্থাত্ পুলিশ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন। সেখানে জনগণের নিরাপত্তা তো বিঘ্নিত হবেই। পুলিশ হত্যা নিয়েও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। সামনে নির্বাচন। এ অবস্থায় পুলিশকে পুরাপুরি ঘুরে দাঁড়াতে হলে সরকারকে আরো গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

‘পুলিশ এখনো আগের সিস্টেমে রয়েছে’ :পুলিশের সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, পুলিশ এখনো আগের সিস্টেমে রয়েছে। আগে রাজনৈতিক নেতাদের ঠিক হতে হবে। নিরপেক্ষ বদলি ও নিয়োগের কথা বলা হলেও কাজের সঙ্গে মিল নেই। এতসব সহিংস ঘটনায় হতাহতের পর পুলিশের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী করতে হলে সেইভাবে গড়ে তুলতে হবে। বদলি, নিয়োগ, পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে করতে হবে। সেখানে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা থাকবে না।

বাসস্থান ও যানবাহন সুবিধা বাড়ানোর দাবি :পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশ কমিশন গঠনের পাশাপাশি বাসস্থান ও যানবাহনসহ সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অতীতে প্রায় সব রাজনৈতিক দল পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অপরাধ যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই তুলনায় পুলিশের প্রযুক্তিগত সুবিধা কম। থানাসমূহে অবকাঠামো, থাকার জায়গা, যানবাহনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও সীমিত। সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ পাবলিক যানবাহন রিকুইজিশন করে জীবন বাজি রেখে পুলিশ সদস্যরা বছরের পর বছর রাজধানীসহ সারা দেশে শিল্পকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে রাতের বেলায় একটি লেগুনায় তিন/চার জন পুলিশ কনস্টেবলের দুটি রাইফেল নিয়ে টহল দেওয়া চরম ঝুঁকিপূর্ণ। যানবাহনসংকটের কারণে মামলার তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে। সময়মতো তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ আদালতে জমা দিতে পারছে না। এ কারণে বিচারকাজে বিলম্ব হচ্ছে।