Image description

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ মিঠাপানি গত দুই দশক ধরে ক্রমাগত কমছে। নতুন এক বৈশ্বিক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে পরিচালিত এবং 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস' জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় ২০ বছরেরও বেশি সময়ের স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

'আনপ্রিসিডেন্টেড কনটিনেন্টাল ড্রাইং, শ্রিংকিং ফ্রেসওয়াটার এভেইলেবিলিটি অ্যান্ড ইনক্রিজিং ল্যান্ড কনট্রিবিউশনস টু সি লেভেল রাইজ' শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানির নির্বিচারে ব্যবহার এবং চরম খরার কারণে ২০০২ সাল থেকে উত্তর গোলার্ধের ১০১টি দেশে মিঠা পানির স্তর দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রায়হান এই গবেষণায় সহায়তা করেছেন। তিনি জানান, 'বাংলাদেশও সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে গত ২০ বছর ধরে মিঠাপানি কমছে। প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ মিমি থেকে ১০ মিমি করে হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।'

এই গবেষণায় ২০০৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় (যা বাংলাদেশের একটি বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত) মোট পানি সংরক্ষণের (টিডব্লিউএস) পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। GRACE/FO স্যাটেলাইটের ডেটা ব্যবহার করে দেখা গেছে, গত ২১ বছর ধরে পানির স্তর ধারাবাহিকভাবে কমছে।

স্যাটেলাইট মানচিত্রে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-মধ্য অঞ্চল লালচে রঙ চিহ্ণিত হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে এই এলাকাগুলোতে প্রতি বছর ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানির সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, 'এই টিডব্লিউএস প্যাটার্নগুলো প্রমাণ করে যে, গত ২১ বছরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মধ্যে থাকা বাংলাদেশের কিছু অংশ দীর্ঘমেয়াদী পানি ঘাটতিতে ভুগছে।'

পিএইচডি শিক্ষার্থী রায়হান বলেন, 'পানির এই ক্ষতি কোনো স্বল্পমেয়াদী পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রবণতা যা গবেষণায় আরও ডেটা যুক্ত করার পরও একই রকম রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের ধারাবাহিক এবং চলমান পরিবর্তনকে 'রোবাস্ট ট্রেন্ড' বলে থাকেন, অর্থাৎ এটি স্থায়ী ও ধারাবাহিক।'

তিনি আরও বলেন, 'এর মানে হলো বাংলাদেশের শুকিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা কোনো আকস্মিক আবহাওয়া বা স্বল্পমেয়াদী ঘটনার কারণে নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরো সময়কাল জুড়ে বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে পানি সংরক্ষণ ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে কমেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।'

এদিকে পানি সংকট অব্যাহত থাকায় গত মাসে সরকার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং চট্টগ্রামের ২৬টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নকে মারাত্মকভাবে পানি-সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ইউনিয়নগুলোর মধ্যে ৪৭টিই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁয় অবস্থিত, আর বাকি তিনটি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। সরকার এই এলাকাগুলোতে পানির অপব্যবহার রোধ করতে একটি নির্দেশনা তৈরি করছে।

বৈশ্বিক সংকট

গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে যে গত দুই দশকে ১০১টি দেশের প্রায় ছয় বিলিয়ন মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ, মিঠা পানির সংকটে পড়েছে।

গবেষকরা দেখেছেন, ভূমিতে সঞ্চিত পানি সংকটের ৬৮ শতাংশই ভূগর্ভস্থ পানির কারণে হয়েছে। গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যতটা বাড়ে, ভূগর্ভস্থ পানি সংকটের কারণে তার চেয়েও বেশি বাড়ে।

এই গবেষণার প্রধান গবেষক এবং এএসইউ-এর স্কুল অফ সাসটেইনেবিলিটির গ্লোবাল ফিউচারস প্রফেসর জে ফ্যামিলিটি বলেন, 'এই গবেষণাটি সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের পানি সম্পদের ওপর যে প্রভাব পড়ছে সে সম্পর্কে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বার্তা দিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'মহাদেশগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, মিঠা পানির সহজলভ্যতা কমছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহারের পরিণতি কোটি কোটি মানুষের খাদ্য ও পানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।'

গবেষণাটির প্রধান লেখক হৃষীকেশ এ. চন্দনপুরকর বলেন, 'হিমবাহ এবং গভীর ভূগর্ভস্থ পানি হলো প্রাচীন ট্রাস্ট ফান্ডের মতো। সংকটকালীন সময়ে ব্যবহার করার কথা, কিন্তু আমরা তা নির্বিচারে খরচ করছি। এর ফলে আমরা দ্রুতই পানি সংকটের দিকে এগোচ্ছি।"

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি পানি, ৪৫ শতাংশ বেশি জ্বালানি এবং ৫০ শতাংশ বেশি খাদ্যের চাহিদা তৈরি হবে।

বাংলাদেশে এ সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তন। হিমালয়ের বরফগলা পানি প্রবাহ কমে যাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ত পানি ঢুকছে, ফলে ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ উভয় ধরনের পানির সহজলভ্যতা আরও কমে যাচ্ছে।

ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্যেরও শিকার। উজানে ভারত ও নেপালের অতিরিক্ত পানি উত্তোলনও বাংলাদেশের পানি প্রবাহকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু কার্যকর আন্তঃসীমান্ত পানি-বণ্টন চুক্তির অভাবে মৌসুমি পানির সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩২ কিউবিক কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। এর ৯০ শতাংশ সেচের কাজে এবং বাকি ১০ শতাংশ গৃহস্থালি বা শিল্প কারখানার কাজে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিষয়ক হাইড্রোলজির সাবেক পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, 'অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি লবণ ও ভারী ধাতু দ্বারা দূষিত হচ্ছে। বর্তমানে ২৪ শতাংশ জমি আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা দেখেছি যে, শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থায়ীভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি বর্ষার পরেও পানির স্তর পুনরায় পূর্ণ হচ্ছে না। উত্তোলন যত বাড়ছে, সময়ের সঙ্গে পানির স্তরের ওঠানামাও তত বাড়ছে।'

২০১৯ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ৭৩ মিমি হারে ভূগর্ভস্থ পানি কমছে। ২০০৬ সালে যেখানে শ্যালো পাম্পের সংখ্যা ছিল ১১ দশমিক ৮ লাখ, ২০১৯ সালে তা বেড়ে ১৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি উত্তোলন করে, যা মিরপুরের ২০টি স্টেডিয়াম পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।

ঢাকার অনেক পরিবারই টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভর করতে পারছে না, অনেককে বাধ্য হয়ে ব্যয়বহুল পানি সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

কেরানীগঞ্জে কয়েক মাস ধরে পানি সংকটে ভুগছেন স্থানীয়রা। 'মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আমরা কোনো পানি পাই না,' বলেন স্থানীয় বাসিন্দা অখিল চন্দ্র দাস।

কৃষকেরাও ভুগছেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার কৃষক শিমুল আলী বলেন, 'সব কৃষকই বোরো ধানক্ষেতে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানিই ব্যবহার করে, কারণ এটি সস্তা। এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে এক মৌসুমে খরচ হয় প্রায় ৩ হাজার টাকা। কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠের পানি দিয়ে সেচ দিতে হলে দিনমজুর ভাড়া করতে হয় বা শ্যালো মেশিন বসাতে হয়, যা আরও ব্যয়বহুল।'

তবে এ বছর বেশি বৃষ্টি হওয়ায় সেচ দিতে হয়নি বলে জানান তিনি।

এদিকে উপকূলীয় গ্রামগুলোতে লবণাক্ত পানির কারণে পানযোগ্য পানির ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তাদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বা অনিরাপদ উৎসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

সীমাবদ্ধতা ও সমাধান

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক ড. জাহিদ বলেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এর সাথে সাথে মিঠা পানির চাহিদাও বাড়ছে, বিশেষ করে সেচ ও শিল্পের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের প্রাকৃতিক পানির মজুদ দিনে দিনে কমছে।'

তিনি ভূ-পৃষ্ঠের পানি ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন যে, বড় পরিসরে বৃষ্টির পানি সংরংক্ষণ এখনও শুরু হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করে না, যা ভূগর্ভস্থ পানি পুনরায় পূর্ণ হওয়ার পথে বাধা দেয়। তাদের মতে, জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে এবং নীতিমালা কার্যকরভাবে প্রয়োগ না করলে পানি ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্তই থেকে যাবে।

২০২৩ সালে নেচার জার্নালে প্রকাশিত এবং নাসার গ্রেস স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করা এক বৈশ্বিক গবেষণাতেও দেখা গেছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে মিঠাপানি হারাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের তথ্যমতে, ঢাকার কিছু এলাকায় প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ২–৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি পানি নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা এবং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমে যাওয়া।

নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ আহমেদ মুক্তা বলেন, যদি আমরা দ্রুত টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার জন্য পদক্ষেপ না নিই, তাহলে বাংলাদেশে মিঠা পানির এই সংকট আমাদের কৃষি, মানুষের স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সাগ্রিক সহনশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।