
দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে ভয়াবহ প্রতারকচক্র সক্রিয়। চাকরি দেয়ার নামে তৈরি করা এই চক্রে জড়িত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও এক শ্রেণির দালাল। বিকালে অফিস সময় শেষে কর্মকর্তারা বেরিয়ে গেলে শুরু হয় এই চক্রের অফিস। ওই সময়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কেউ বনে যান সচিব, কেউবা উপসচিব; কেউ আবার তাদের পিএ সাজেন। রীতিমতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষে, কখনো বা তাদের চেয়ারেই বসেন এই চক্রের সদস্যরা। কখনো উপসচিবের কক্ষে, কখনো যুগ্ম সচিবের কক্ষে চলে চাকরির কথিত ইন্টারভিউ। এই প্রতারণা কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেয়ার নামে একেক জনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ১০ থেকে ১৮ লাখ টাকা করে।
দেশে শিক্ষিত বেকার যুবকেরা চাকরির জন্য নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন। আর তাদেরই জন্য ওঁৎ পেতে তাকে সচিবালয়ের এই প্রতারক চক্র। জানা গেছে, ভয়াবহ এই চক্রের সদস্যরা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের প্যাডে সংশ্লিষ্ট উপসচিবের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। চাকরির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ‘একমাত্র রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহার্য’ লেখা সরকারি খামে সচিবের নামে তারা ভুয়া নিয়োগপত্র দেন। মোটা অংকের টাকা দেয়ার পর মাসের পর মাস ঘুরেও যখন চাকরিপ্রত্যাশীরা কর্মস্থল পায় না, তখন তাদের হাতে ট্রেনিং পিরিয়ডের নামে দু-এক মাসের বেতনও তুলে দেয় চক্রটি। তাদের এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্ধশতাধিক তরুণ-তরুণী সর্বস্ব হারিয়েছেন। তাদের অনেকে এখন হতাশা নিয়ে ঘুরছেন পথে পথে।
তেমনই প্রতারণা শিকার একজন একেএম মোসলেহ উদ্দিন। তিনি ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় এই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-১৩) করেন। তার মামলায় অভিযোগ করা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের (প্রশাসন) স্বাক্ষর জাল করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চেয়ারে বসে, রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার্য খামে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র দেয়ার মাধ্যমে দুই চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। মামলায় আসামি করা হয় সচিবালয়ে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. শফিকুল ইসলাম (ফরাশ শাখা- সকালে অফিসের তালা খোলা এবং বিকালে তালাবদ্ধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী), কেএম মোর্তুজা আলী রনি এবং তাদের সহযোগী দালাল মো. শাহিনুল কাদির সুমন ওরফে পালসার সুমনকে। এরপর সচিবালয়ের কর্মচারী শফিকুল ইসলাম ও বহিরাগত দালাল পালসার সুমন গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও ওই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে মিরপুর থানা পুলিশ। এরপর দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২৪ সালে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেয় সিআইডি। মামলায় ৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩ জন ইতোমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে রহস্যজনক কারণে প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রাসেল আহমেদ আসছেন না সাক্ষ্য দিতে। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হলেও তিনি আদালতে আসছেন না। সবশেষ গত ২৭ জুলাই তার আদালতে হাজির হওয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল। সেদিনও তিনি উপস্থিত হননি। ফলে সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে বিচার কার্যক্রম।
এদিকে আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, ব্যক্তিগত সহকারীসহ নানা পদে চাকরির আশায় এই প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়েছেন মাগুরার অন্তত ৩০ বেকার যুবক। তারাও প্রতারিত হয়ে এখন পথে বসেছেন। তাদের কাছ থেকে চক্রটি প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগী মাগুরা শহরের মীরপাড়ার বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করেন, তার ছেলে মাহবুবুল আলম হাসানকে সচিবালয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রতারক চক্রের সদস্য শাহিনুর কাদির সুমন ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া মাগুরা সদরের রূপাটি গ্রামের ওহাব মোল্যার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, একই গ্রামের গোলাম রসুলের ছেলে তানভির, একই গ্রামের ছানোয়ার আলী, ঝিনাইদহের শ্রীফলতলা গ্রামের আবু সাঈদ আল ইমরান, মাগুরা সদরের বাগিয়া গ্রামের শাহিনুর রহমান, মাঝাইল গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হাজীপুর গ্রামের ইমরান সিদ্দিকের কাছ থেকে চাকরি দেয়ার কথা বলে ৭৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এই ভুক্তভোগীদেরও বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত সুমন চাকরিতে যোগদানের জন্য আলাদা নিয়োগপত্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের উপসচিব ‘ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত’ অফিস আদেশ দেন। এসব নিয়োগপত্র ও অফিস আদেশ পেয়ে ভুক্তভোগীরা সচিবালয়ে গেলে বুঝতে পারেন তারা প্রতারণার বিষয়টি।
ভুক্তভোগী মোসলেহ উদ্দিন বলেন, তিনি তার বোন নুরুন্নাহার ও শফিকুল ইসলাম নামে পরিচিত একজনের চাকরির জন্য এই চক্রের হাতে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন। প্রতারকচক্রটি তাদের সঙ্গে ভুয়া নিয়োগপত্র ও অফিস আদেশের মাধ্যমে একইভাবে প্রতারণা করেছে।
মোসলেহ উদ্দিন বলেন, “প্রতারক সুমন আমার বোন নুরুন্নাহারকে সচিবালয়ে নিয়ে সার্ভিস বুক খুলে বেশ কিছুদিন কাজও করিয়েছে। এমনকি এক মাসের বেতনও দিয়েছে। আঙুলের ছাপ নিয়েছে। সবই ছিল ভুয়া।”
তার অভিযোগ, মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক রাসেল (রাজধানীর মিরপুর থানার তৎকালীন এসআই) প্রথম থেকেই আসামিদের গ্রেপ্তারে গড়িমসি করেন। এখন তার সাক্ষীর জন্য থমকে আছে বিচার কার্যক্রম।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পরিদর্শক রাসেলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
শীর্ষনিউজ