আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকটা থমকে যায় দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাদ পড়েছে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প। চলমান কিছু প্রকল্পে কমানো হয়েছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও প্রকল্প কাটছাঁটেও ইতিবাচক ধারায় থাকবে অর্থনীতি।চলতি বছর মোট বরাদ্দ ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম পাঁচ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। খরচ হয়েছে ৩৪ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। এ সময়ে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ১০টি মন্ত্রণালয়-বিভাগের বাস্তবায়ন ৫ শতাংশের নিচে। বাকি সাত মাসে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা খরচ করা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। ফলে বৈদেশিক ঋণের ২০ হাজার কোটি টাকাসহ এডিপি থেকে সরকারি অর্থায়ন মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা কমছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।অর্থনীতিবিদদের দাবি, বিগত সময়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এডিপিতে ঢুকেছে। এসব প্রকল্প বছরের পর বছর টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে নেই। প্রকল্পের সংখ্যা কমলেও যদি মানসম্মতভাবে কাজ করা যায় তবে প্রবৃদ্ধি বা অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে না। বর্তমানে অর্থনীতি কিছুটা চাপে আছে। মূল্যস্ফীতিও বেশি। প্রকল্প সংখ্যা কমিয়ে এসব বিষয়ে নজর দেওয়া উত্তম।
‘প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না’
বড় আকারে উন্নয়ন ব্যয় কমছে। এতে পরবর্তী অর্থবছরে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছর প্রকল্পের একটা সংখ্যা আছে। প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা জরুরি। এতে অর্থনীতির গতির সম্পর্ক আছে।’
সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা কমায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, ‘আগে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হতো। অর্থায়ন না করে বসিয়ে রাখা হতো। এতে ব্যয় ও খরচ বেড়ে যায়। প্রকল্পের সংখ্যা কমলেও বিদ্যমানগুলো বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। যেগুলো আছে সেগুলো সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যেন আরও নজর দিতে পারে। জনবান্ধব প্রকল্প নিতে হবে, যে সব প্রকল্পে রিটার্ন ভালো।’
অনেক প্রকল্প রাজনীতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অর্থায়নের নিশ্চয়তা দেখা হয়নি। সুতরাং এডিপি থেকে এসব প্রকল্প কমলেও বড় ধরনের সমস্যা হবে না। কারণ রাজস্ব আদায় কম, পণ্যের উচ্চমূল্য দেখা যাচ্ছে। সেখানে ব্যয় সাশ্রয় হওয়া ঠিক আছে।- সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান
তিনি বলেন, ‘অপচয়-দুর্নীতি কমাতে পারি কি না এটা জরুরি। ফলে কাটঁছাট হলেও প্রবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে না। অনেক আগের প্রকল্প রয়ে গেছে, যা প্রয়োজন নেই। অনেক প্রকল্প রাজনীতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অর্থায়নের নিশ্চয়তা দেখা হয়নি। সুতরাং এডিপি থেকে এসব প্রকল্প কমলেও বড় ধরনের সমস্যা হবে না। কারণ রাজস্ব আদায় কম, পণ্যের উচ্চমূল্য দেখা যাচ্ছে। সেখানে ব্যয় সাশ্রয় হওয়া ঠিক আছে।’অর্থনীতিবিদদের দাবি, জুলাই-আগস্টে একদিকে যেমন উন্নয়ন ব্যয় হয়নি অন্যদিকে রাজস্ব আহরণেও ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং, উন্নয়ন ব্যয় সাশ্রয় ছাড়া কোনো উপায় নেই। চলতি অর্থবছর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে পরবর্তীসময়ে জনগণের টাকায় সঠিক প্রকল্প নেওয়া উত্তম হবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
‘উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করা ছাড়া কোনো গতি নেই’
সরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেখতে দেখতে অর্থবছরের অর্ধেক চলে গেছে। বাকি ছয় মাসে কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে? যেনতেনভাবে ব্যয় করা উচিত হবে না। সম্পদের সংস্থান কিন্তু বড় ফ্যাক্টর। নিজস্ব সম্পদ ও বৈদেশিক রিসোর্সও কম। সুতরাং উন্নয়ন কমানো ছাড়া গতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘প্রায়োরিটি প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকবে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। জুলাই-আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় হয়নি। উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করা ছাড়া কোনো গতি নেই। বাস্তবায়ন করতে টাকা লাগবে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় জায়গায় টাকা খরচ হচ্ছে এটা অর্থনীতির ইতিবাচক দিক।’
প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া ১৩টি বড় প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব প্রকল্পে মোট ৫২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে চারটি প্রকল্প চলমান, যেগুলোর সংশোধিত প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। আর প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ৯টি।
অনেক প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় হয়নি। উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করা ছাড়া কোনো গতি নেই। বাস্তবায়ন করতে টাকা লাগবে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় জায়গায় টাকা খরচ হচ্ছে এটা অর্থনীতির ইতিবাচক দিক।- ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী
পুনর্মূল্যায়নের উদ্দেশ্য যেসব প্রকল্পে সুফল পাওয়া যাবে না বা এই মুহূর্তে করা জরুরি নয় সেগুলো বাদ দেওয়া। আবার কিছু প্রকল্পের অগুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও বাদ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। ধাপে ধাপে একনেক সভায় প্রকল্পগুলো বাতিল হবে। যেমন লাঠিটিলা বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, মৌলভীবাজার (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পটি বাতিল করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। লাঠিটিলা বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে খরচ ধরা হয় ৩৬৪ কোটি ১১ লাখ টাকা।
চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা এই ১৩ প্রকল্পই কেবল নয়, বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকা প্রকল্প বাদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রায় সব প্রকল্পই নতুন করে মূল্যায়ন করা হবে।অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো রাখা হবে
বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিবি) চলমান প্রকল্প রয়েছে, ১ হাাজার ৩৫২টি। এগুলোর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করে অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো রাখা হবে। এতে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, ‘আমরা অহেতুক প্রকল্প বাতিলের কাজ করছি। বাজেট ঘাটতি সহনীয় রেখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সংশোধনের কাজ করছি। উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করে এই অর্থ অন্য কিছু খাতে ব্যয় হবে। এতে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছোট হলেও প্রবৃদ্ধি কমবে না। আমাদের লক্ষ্য কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং জনগণের উপকার করা। মানুষের কল্যাণে আছে ও কর্মসংস্থান বাড়বে এমন প্রকল্প বেশি বাস্তবায়ন করা হবে।’