Image description

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ফার্নেস অয়েল, কয়লা এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে ভারত ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।

 

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ফার্নেস অয়েল, কয়লা এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে ভারত ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। প্রতি বছর এসব প্রাথমিক জ্বালানি ও আমদানি বিদ্যুৎ দিয়ে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৬২ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ হচ্ছে। শেষ হওয়া অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ চাহিদা আরো বেড়েছে বলে জ্বালানি খাতের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) গবেষণায় উঠে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ ৪০ থেকে বেড়ে প্রায় ৬২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি এ বিদ্যুতের পরিমাণ আরো বেড়েছে, যা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। দেশের বিদ্যুৎ খাতের বিপুল পরিমাণ আমদানিনির্ভরতা কমাতে হলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে এ খাতে সরকারি যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার জন্য বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।

গতকাল রাজধানীর মালিবাগের কসমস সেন্টারে ‘জ্বালানির রূপান্তর: বাংলাদেশ কি সঠিক পথে?’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন আইইইএফএর বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম।

 

তিনি বলেন, ‘দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের বড় অংশ এখন আমদানিনির্ভর। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের যে ব্যবহার হচ্ছে, তার ২৫-৩০ শতাংশই আমদানি। এছাড়া জ্বালানি তেল ফার্নেস অয়েল আমদানি করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানিনির্ভর এসব জ্বালানির হিসেব বিবেচনায় নিলে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ৬২ শতাংশ আমদানি হচ্ছে।’

 

সেমিনারে উত্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধে দেখানো হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ৭১ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। যার মধ্যে ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে আমদানি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮০ হাজার ৪২৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে। যার মধ্যে ৫০ শতাংশ আমদানি বিদ্যুৎ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, ব্যবহৃত এ বিদ্যুতের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানিনির্ভর জ্বালানি ও ক্রস বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে ৮৮ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় এক লাখ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানি ও সরাসরি বিদ্যুৎ আমদানি করতে গিয়ে মোট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দফায় দফায় বেড়েছে, যা সরকার ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) দিয়েছে।

প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের প্রতি কিলোওয়াট উৎপাদন খরচ ছিল ৪ টাকা ৮৮ পয়সা। আর গড় বিক্রিমূল্য ছিল ৫ টাকা ৯১ পয়সা। বিদ্যুতের বিক্রি ও ক্রয়ের এ ব্যবধান প্রতি ইউনিটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ টাকা ৫৭ পয়সা ঘাটতি তৈরি করেছে। ওই অর্থবছরে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল ১১ টাকা ৩৫ পয়সা, সেখানে গড় বিক্রিমূল্য ছিল ৬ টাকা ৭৮ পয়সা।

বিদ্যুৎ খাতে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে সেমিনারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘দেশে বছর বছর বিদ্যুতে ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় কীভাবে তৈরি হয়? আমরা একে বলি লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বা মুনাফা। এগুলোর সমন্বয় হয়ে যখন ব্যয় বাড়ে, তখন ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়, পরে ভর্তুকি বাড়ে। কথাটি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো স্বীকার করে না। উল্টো বলে, উৎপাদন ব্যয়, আমদানি ব্যয়, ডলারের দাম বেড়েছে। সেজন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। আমাদের এখানে প্রাইসিং বোঝার মতো লোক নেই। বুঝে থাকলেও তিনি সে প্রাইসিং কীভাবে করছেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, ‘পৃথিবীর সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু সূর্যের আলো কেউ বন্ধ করতে পারবে না। এটি খুব কম খরচেই উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়ার সঠিক পরিকল্পনা নিচ্ছি না। আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম বিভাগে যে পরিমাণ খাসজমি আছে, সেখানের ৫ শতাংশ ব্যবহার করলেও ২৮ হাজার মেগাওয়াট সোলারের প্রকল্প করা সম্ভব। বিপিডিবির অবস্থা এখন খুবই খারাপ। এটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) যেভাবে দুই ভাগ করা হয়েছে, সেভাবে বিপিডিবিকেও ভাগ করা উচিত। এর মধ্যে একটি রেগুলেটরি অথরিটি ও আরেকটি থাকবে সরকারের কী-পয়েন্ট ইনস্ট্রলেশনগুলো পাওয়ার প্লান্টে সরবরাহের দায়িত্ব।’

এ সময় নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও করণীয় সম্পর্কে মতামত ‍তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ‘‌সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়াল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সক্ষমতা খাত উভয়কেই পরিচালনা করার পর্যাপ্ত জনবল নেই। ইপিসি কোম্পানিগুলোর বছরে কয়েক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্প বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে। সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়নের সক্ষমতা নেই।

সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ ও ২০৪০ সালের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করা, এরপর ধাপে ধাপে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা; রুফটপ সৌর প্রকল্পের জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা; ক্ষুদ্র-আকারের প্রকল্পগুলোর জন্য আমদানি সরঞ্জাম সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত করা; বার্ষিক শক্তি সঞ্চয় লক্ষ্য নির্ধারণ এবং এ অর্জনের অগ্রগতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা; এলএনজি নির্ভরতা কমানো; সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়াল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সক্ষমতা উন্নয়ন; সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবহার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখানে অর্থায়ন করতে পারে।

সেমিনারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও কসমস ফাউন্ডেশনের সভাপতি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন কসমস এডুকেশনের পরিচালক কাটে-জারো-খান, বুয়েটের সাবেক ডিন ড. ইজাজ হোসেন, অধ্যাপক ফারসিম মান্নান মোহাম্মদী, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তি, ক্লিনের ক্যাম্পেইন অফিসার মোহাম্মদ নোমান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির ক্যাম্পেইন এবং নীতি সমন্বয়কারী বারিশ হাসান, ধরার সদস্য শমশের আলী প্রমুখ।