Image description
নিহত ৩২২ নারী

ফাহমিদা তাহসিন কেয়া। ঘর বেঁধেছিলেন সিফাত আলীর সঙ্গে। এই দম্পতির ঘর আলোকিত করে আসে একে একে চার সন্তান। সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন পঁচিশ বছর বয়সী এই মা। পরম মমতায় আগলে রাখতেন সন্তানদের। তবে সেই মায়া-মমতা বেশিদিন টেকেনি সন্তানদের ভাগ্যে। ১৩ই আগস্ট মধ্যরাতে তার মৃত্যু হয়। পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণির একটি বাসায় স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকতেন। কেয়ার পরিবারের অভিযোগ, সিফাত খুবই বদমেজাজি। সন্তানদের সামনেই কেয়াকে মারধর করতেন। পারিবারিক কলহের জেরেই স্বামী সিফাত আলী স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর কৌশলে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় কেয়ার মা নাজমা বেগম বাদী হয়ে কেয়ার স্বামী সিফাতসহ নয় জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। শুধু কেয়া নয়, প্রতিনিয়ত এমন নৃশংস ঘটনার শিকার হচ্ছে নারীরা। নির্যাতন ও সহিংসতা সহ্য করতে না পেরে অনেকে বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ। আবার অনেকের নৃশংসভাবে বলি হতে হচ্ছে স্বামীর হাতে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পারিবারিক সহিংসতার মর্মান্তিক ঘটনায় ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে জনমনে।

পরিসংখ্যানে নৃশংসতার চিত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩২২ জন নারী পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ১৩৩ জনকে হত্যা করেছেন তাদের স্বামী। আত্মহত্যা করেছেন ১১৪ জন। একই সময়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ স্বামীর নির্যাতনের অভিযোগে ৯ হাজারের বেশি কল রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৭০ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার অর্ধেকের বেশি স্বামীর হাতে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) সংগঠনটি বলছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা বারবার এমন নৃশংস অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা নারীর প্রতি দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতা ও ভয়াবহ সংকটকে আরও প্রকট করছে। এমজেএফ-এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, অসংখ্য ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না। 

৭ মাসে নির্যাতনের ১৩,১৩০ মামলা: চলতি বছরের সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১৩ হাজার ১৩০টি। পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যনুযায়ী, জানুয়ারিতে ১ হাজার ৪৪০টি মামলা, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৪৩০টি, মার্চে ২ হাজার ৫৪টি, এপ্রিলে ২ হাজার ৮৯টি এবং মে মাসে ২ হাজার ৮৭টি, জুন মাসে ১ হাজার ৯৩৩টি এবং জুলাই মাসে ২ হাজার ৯৭টি মামলা হয়েছে।

কেয়ার মৃত্যুর একদিন পর কদমতলিতে তুচ্ছ ঘটনায় স্বামীর হাতে খুন হন ১৯ বছর বয়সী তামান্না আক্তার কাজল। তিন বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেন নয়ন ইসলামকে। তাদের ঘরে রয়েছে এক বছর বয়সী কন্যা সন্তান। ১৪ই আগস্ট বিকালের দিকে রহস্যজনক মৃত্যু হয় তামান্নার। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের পর তামান্নাকে হত্যা করেছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ ঘটনায় সাতজনকে আসামি করে কদমতলি থানায় মামলা করেছেন নিহতের বাবা নায়েব উল্লাহ। পুলিশ তামান্নার স্বামী নয়নকে গ্রেপ্তার করেছে।

গত বৃহস্পতিবার গাইবান্ধায় এক নববধূ (১৮)কে বিয়ের পরদিন দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, গত বুধবার সাঘাটা উপজেলার এক তরুণের সঙ্গে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার এক তরুণীর বিয়ে হয়। নতুন বউকে নিয়ে সাঘাটার বাড়িতে চলে যায় বরপক্ষ। পরের দিন বৃহস্পতিবার নববধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে বর ও তার ছয় বন্ধুকে বাড়ির লোকজন মারধর করেন। শুক্রবার নববধূর বাড়ির লোকজন বর, তার বন্ধুসহ সাতজনকে গোবিন্দগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে প্রেমিকের সঙ্গে পালাতে রাজি না হওয়ায় এক কিশোরীকে কুপিয়ে জখম করেছে ইয়াসিন মিয়া নামের এক যুবক। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই কিশোরীর ভাই ৫ জনকে আসামি করে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা করলে ৩ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

যা বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, কোনো দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হওয়ার পেছনে ঘাটতি থাকে, তখন ওই সমাজের মানুষকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, নিপীড়িত, হত্যা, ধর্ষণ কিংবা শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ও একক পরিবারের প্রবণতা থেকে বাড়ছে পারিবারিক কলহ ও হত্যার ঘটনাও।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে প্রান্তিক বৈশিষ্ট্যের নারী যারা, যে সমস্ত পুরুষ মনে করে এই নারীদের উপরে যেকোনো ধরনের অন্যায় বা সহিংসতা হলে সে আসলে বিচার চাইবে না বা বিচার চাওয়ার মতো তার অবস্থা নেই বা তার হয়েও কেউ লড়বে না- এ ধরনের বাস্তবতায় এই সমাজের নারীরা বেশি নির্যাতিত হয়। এদিকে, অতীতে নারী ও শিশুদের ওপর যে সহিংসতাগুলো হয়েছে,  সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার করতে না পারা। প্রত্যেক নাগরিকেরই সুরক্ষা রাষ্ট্রের নিশ্চিত করতে হবে। এই নারী-শিশুর ওপরে সহিংসতাসহ সকল ধরনের অপরাধকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।