Image description

বহুল কাঙ্ক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের শুরুটা উৎসবমুখর হলেও শেষটায় এসে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দলগুলো থেকে ভোট কারচুপির ব্যাপক পাল্টাপাল্টি অভিযোগে ভোটের দিন দুপুর থেকেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু হয়। যদিও উপাচার্য ভোট কারচুপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পক্ষপাতের কোনও সুযোগ নেই।

ভোট প্রদানের শুরু থেকে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি কেন্দ্রে। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় কেন্দ্রগুলোতে। প্রায় সবকটি ভোটকেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।

সকাল ৮টায় উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী মো. আবিদুল ইসলাম খান ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম বাইরে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন এবং ভোট ও দোয়া চাইছেন। কিন্তু দুপুরের পরই বদলে যেতে শুরু করে পরিস্থিতি।

 

টিএসসিতে হেনস্তার শিকার সহকারী প্রক্টর, ছাত্রদল-শিবির পাল্টাপাল্টি অভিযোগটিএসসিতে হেনস্তার শিকার সহকারী প্রক্টর, ছাত্রদল-শিবির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

শুরুটা যেভাবে

 

সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া নির্বাচনের ৩ ঘণ্টায় বেশিরভাগ কেন্দ্রেই ভোট পড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। একাধিক কেন্দ্রে ৩৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এর পরপরই নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তোলে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের প্যানেল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী জোট। তাদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অমর একুশে হলে আগে থেকে ব‍্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছে। এছাড়া শামসুন্নাহার হলেও কয়েকজন শিক্ষক একটি প্যানেলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ নির্বাচনকে নীলনকশার নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী জোট।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিবিরের এস এম ফরহাদ অভিযোগ করে বলেন, ‘ইউল্যাব স্কুল কেন্দ্রে সকাল ৯টা পর্যন্ত কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্যানেলের একজন এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে। অমর একুশে হলে আগে থেকেই ছাত্রদলের সিল মারা ব‍্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছে।’

এরই পরিপ্রেক্ষিতে টিএসসির রোকেয়া হল কেন্দ্রে কিছুটা উত্তেজনা দেখা যায়। দুপুর দেড়টার দিকে লিফলেট বিতরণকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাসিরের সঙ্গে প্রশাসনের বাগবিতণ্ডার জেরে এই উত্তেজনা দেখা দেয়। তার অভিযোগ, প্রশাসন শিবিরের পক্ষে কাজ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করা হচ্ছে।

নাছির উদ্দিন নাসির অভিযোগ করে বলেন, ‘শিবিরের প্যানেলের পক্ষে ব‍্যালটে আগে থেকেই সিল মারার অভিযোগ দিতে গেলে প্রশাসন আমাদের সঙ্গে অপ্রীতিকর আচরণ করে। আমাদের কোনও কথা শুনতে চায়নি।’ ছাত্রদলের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপস্থিত ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করে। তাৎক্ষণিক টিএসসির ভোটের পরিবেশ বিঘ্নিত হয়, এমনকি মিনিট দশেক ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে।

ইউল্যাব স্কুল কেন্দ্রে ছাত্রদলের বিক্ষোভ, ছাত্রীদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ইউল্যাব স্কুল কেন্দ্রে ছাত্রদলের বিক্ষোভ, ছাত্রীদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়কারচুপি নিয়ে শিবির-ছাত্রদলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

দুপুর পেরিয়ে বিকাল গড়াতেই ভোট কারচুপির অভিযোগ নিয়ে ছাত্রশিবির,  ছাত্রদল এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। এর মাঝে হেনস্তার শিকার হয়েছেন ঢাবির সহকারী প্রক্টর নূরে আলম সিদ্দিকী। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আরও বেশি ঘোলাটে হতে থাকে।

ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘যে নির্বাচন আশা করেছিলাম, তা হয়নি। আজ সকাল থেকেই নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আগে থেকে পূরণ করা ব‍্যালট থাকার অভিযোগ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। দুটি কেন্দ্রে এমন অভিযোগ এসেছে। সুতরাং আরও কেন্দ্রে রয়েছে।’

বহিরাগত জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরির অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ১২টি লিখিত অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে ডাকসু নির্বাচন ঘিরে কেউ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চায় তাহলে তাদের পরিণতি শেখ হাসিনা এবং ছাত্রলীগের চেয়েও খারাপ হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, ‘‘ডাকসু নির্বাচনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার, যারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। প্রশাসনকে অনুরোধ করবো—যারা জড়িত তাদেরকে দ্রুত সময়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনা হোক।’

মেঘমল্লারের ভিডিও বার্তা

জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু শুরু থেকে সবার আলোচনায় ছিলেন। অসুস্থ থাকায় প্রচারণা থেকে দূরে থাকলেও শেষদিনে ক্যাম্পাসে হাজির হন হুইল চেয়ারে করে। তার বক্তব্যে সবসময়ই অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে আসার আহ্বান ছিল। দিনশেষে তিনি একটি ভিডিওবার্তা ফেসবুকে দেন। যেখানে তিনি সারা দিনের অভিযোগগুলো স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, ‘অমর একুশে হলে ব্যালট ছিল, সেগুলো আগে থেকে ভরাট করে বাক্স ভর্তি করার কর্মকাণ্ড করা হয়েছে। এছাড়াও আমরা দেখেছি, রোকেয়া হলে ভিপি এবং জিএস পদে এস এম ফরহাদ এবং সাদিক কায়েমের নাম বসিয়ে দিয়ে সেই ব্যালট শিক্ষার্থীদের কাছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শহীদুল্লাহ হলে শিবিরের পূরণ করে রাখা লিস্ট ভোটারকেন্দ্রের ভেতরে আগে থেকেই রেখে দেওয়া হয়েছে। এরকম ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরেও আমরা ভুয়া ভোটারের কয়েকটি ঘটনা দেখেছি। আমরা আরও অনেকগুলো ঘটনা দেখেছি, যেখানে আমাদের প্রতিরোধ পর্ষদের ক্যান্ডিডেটসহ আরও অনেককেই বিভিন্ন রকমের জ্যামিংয়ের ও ব্লকেডের মধ্য দিয়ে তাদের ন্যায্য প্রচারণা করতে দেওয়া হয়নি। সেদিক দিয়ে নির্বাচনের অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা দৃশ্যমান রয়েছে।’

পর্যবেক্ষক শিক্ষক নেটওয়ার্ক কী দেখলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে সংবাদ সম্মেলনে জানান, ডাকসু নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত বড় ধরনের কোনও সমস্যা তাদের চোখে পড়েনি। অপরদিকে শিক্ষক নেটওয়ার্কের আরেক সদস্য অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেছেন, এবারের ডাকসু নির্বাচন বেশ অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। যদিও ছাত্রদলের প্রার্থীরা নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কেমন হয়েছে— এখনও পর্যন্ত তা বলার সময় হয়নি। নানান গুজব-অস্থিরতা আছে। প্রশাসনের কিছু বিষয়ে অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। তথ্যের গ্যাপ এবং ভুল বোঝাবুঝিও দেখা গেছে। সবাই যথেষ্ট পোলিং এজেন্ট পাননি। অনেকেই পাস পেয়েছেন দেরিতে। কেউ কেউ আবেদন করেও পাননি। এমন কিছু কিছু ঘাটতি ছিল।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, দুটি হলের কেন্দ্রে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সমভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। কিছু কিছু যায়গায় অস্বচ্ছতা দেখা গেছে। দুটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ ধীরগতিতে হয়েছে। এছাড়া রোকেয়া হলে সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে ছাত্রদলের বাগবিতণ্ডায় ভোটগ্রহণ কমে গেছে। অনেকেই আসেননি।

ভিসির ভরসা পোলিং এজেন্ট, সিসি ক্যামেরা ও সাংবাদিক

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান সাংবাদিকদের কাছে ভোটে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ আশঙ্কা নেই জানিয়ে বলেন, ‘‘ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ও সাংবাদিকরা ছিলেন। সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সংখ্যক বুথের প্রতিটি পদক্ষেপ আগাম ঘোষণা দিয়ে করা হয়েছে। গণনা পর্বেও সাংবাদিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে।’’

ক্যাম্পাসের প্রবেশ মুখগুলোতে ছাত্রদল এবং শিবিরের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভোটগ্রহণ শেষে জানতে পারলাম, গেটের বাইরে কিছু লোক সমাগম হচ্ছে। এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা নিরাপত্তা জোরদার করেছে।’’

এবারের ডাকসুতে ভোট পড়েছে ৭৮ শতাংশ

এবারের ডাকসু নির্বাচনে সর্বমোট ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে সূর্যসেন হল থেকে, এ হলের ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়েছেন। কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান হল (৮৭ শতাংশ), শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল (৮৪.৫৬ শতাংশ), হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল (৮৩.৩৭ শতাংশ) এবং অমর একুশে হল (৮৩.৩০ শতাংশ)। এ ছাড়া জগন্নাথ হল (৮২.৪৪ শতাংশ), মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল থেকে ৭৫ শতাংশ এবং স্যার এ এফ রহমান হল থেকে ৮২.৫০ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করা হয়েছে।

অপরদিকে, কবি জসীমউদ্দীন হল থেকে ডাকসুতে ভোট পড়েছে ৮৬ শতাংশ, বিজয় একাত্তর হল থেকে ৮৫.০২ শতাংশ ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ৮৩ শতাংশ। এছাড়া মেয়েদের আবাসিক হলগুলোর মধ্যে রোকেয়া হল থেকে ৬৫.৫০ শতাংশ, কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে ৬৪ শতাংশ ও শামসুন নাহার হল থেকে ৬৩.৬৭ শতাংশ ভোটপ্রদান করা হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল থেকে ৬৮.৩৯ শতাংশ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে ৬৭.০৮ শতাংশ ভোট দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে হলে হলে ভিন্ন চিত্র থাকলেও সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটপ্রদানের ফলাফলের গড় দাঁড়িয়েছে ৭৮.৩৩ শতাংশ।