পবিত্র রমজান মাসে বেশি ব্যবহৃত ভোগ্যপণ্যের দরে নিম্নমুখী প্রবণতা চলছে আন্তর্জাতিক বাজারে। অন্যদিকে বেশিরভাগ পণ্য আমদানিতে বড় ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে রমজানের নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। পাইপলাইনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। তবু রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কারসাজির শঙ্কা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের কঠোর নজরদারি।ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে রমজান মাস শুরু হবে। ডলারের দাম ঠিক থাকলে রমজানে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগে থেকেই চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ছোলা, মটর, মসলা, খেজুরসহ ১১টি পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খোলায় মার্জিন কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে। যার সুফল পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এমন অবস্থায় ওই সুফল যেন সাধারণ মানুষও পান, সেটা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
‘তেল ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দামও কম। চিনি নিয়েও এখন সমস্যা নেই। আশা করা হচ্ছে, এবার রমজানে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।’ - মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার
বাংলাদেশ ব্যাংকের পণ্য আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, ছোলা ও খেজুরের আমদানি বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়। তবে কমেছে চিনি ও পেঁয়াজের আমদানি। বর্তমানে পেঁয়াজের ভরা মৌসুম হওয়ায় বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
চিনির আমদানি পরিস্থিতি
অপরিশোধিত চিনি আমদানি কিছুটা কম হলেও পরিশোধিত চিনি আমদানি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে। ফলে রোজার আগে চিনির আমদানি আরও বাড়বে, সংকট হবে না- এমনটাই বলছে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো।গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের গত ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ছয় লাখ ৬৪ হাজার ১৭৬ মেট্রিক টন চিনি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার পাঁচ টন, পরিশোধিত এক লাখ এক হাজার ১৭১ টন। একই সময়ে গত অর্থবছর আট লাখ ৬৪ হাজার ৮০ টন চিনি আমদানি করা হয়েছিল। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি সাত লাখ ৯৯ হাজার ৫০৮ টন, পরিশোধিত ৬৪ হাজার ৫৭১ টন।
এছাড়া গত ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আট লাখ ৮৯ হাজার ২৮৪ টন চিনি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। গতবার এর পরিমাণ ছিল নয় লাখ ১৬ হাজার ৪২৫ টন। আমদানির পাইপলাইনে আছে তিন লাখ ৭৬৮ টন চিনি। দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন। আমদানি হয় ২১ থেকে ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা তিন লাখ টন।
এ বিষয়ে দেশের অন্যতম আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজানের পণ্য ঠিকঠাক আমদানি হচ্ছে। তেল ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম কমও আছে। চিনি নিয়েও এখন কোনো সমস্যা নেই। আশা করা যাচ্ছে, এবার রমজানে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।’
সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি
গত মাসে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ ক্রেতারা। সেই সংকট কাটলেও এখনো বাজারে সয়াবিন তেলের টান রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ রমজানে তেলের সরবরাহ নিয়ে এখনো চিন্তিত।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র ধরে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৫ টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল তিন লাখ ৮৪ হাজার ৮০ টন ও পাম তেল সাত লাখ ১১ হাজার ৪৪৪ টন।
২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ১২ লাখ ৫০ হাজার ৫৮৪ দশমিক ২১ টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল দুই লাখ ৭৫ হাজার ৭৬ টন, পাম তেল নয় লাখ ৭৫ হাজার ৫০৭ টন।
‘আন্তর্জাতিক বাজারেও এই মুহূর্তে কোনো পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা নেই। তবে আমরা ঠিকমতো ডলার পাবো কি না সেটা নিয়ে চিন্তিত। ডলারের দাম ঠিক থাকলে পণ্যের দামে হেরফের হবে না।’ – টি কে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আতহার তাসলিম
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে এলসি খোলার তালিকায় অন্যান্য নিত্যপণ্য থাকলেও সয়াবিন ও পাম তেল নেই। তবে আমদানির পাইপলাইনে রয়েছে চার লাখ ২১ হাজার ৯৬৬ টন তেল। ২০২৩ সালে আমদানির পাইপলাইনে ছিল তিন লাখ ৬১ হাজার ৬৬৭ টন তেল।
পাইপলাইনে থাকা তেল রমজানের আগে আসবে। ট্যারিফ কমিশন বলছে, বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন তেল দেশে উৎপাদিত হয়। ২২ থেকে ২৩ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা তিন লাখ টন। সেই হিসেবে রমজানে তেলের কোনো সংকট থাকার কথা নয়।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার ঢাকার মৌলভীবাজারের বড় ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছুদিন আগেই তেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এরপর পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আগে থেকেই কিছুটা কমতির দিকে। আশা করছি, কোম্পানিগুলো সরবরাহ ঠিক রাখলে তেলের দামে আর সমস্যা হবে না।’
ছোলার আমদানি অনেক বেশি
পুরো বছরে ছোলার চাহিদা এক লাখ ৮০ হাজার থেকে দুই লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসেই চাহিদা এক লাখ টন। দেড় থেকে দুই লাখ টন ছোলা প্রতি বছর আমদানি করতে হয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৯৮০ টন ছোলা আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৭ হাজার ৪৪৬ টন ছোলা। এবার একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার ৯১৯ টন। গতবার খোলা হয়েছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৪৫৪ টন।
এবার আমদানির পাইপলাইনে আছে এক লাখ ৫৪ হাজার ১৯১ টন ছোলা। গতবার পাইপলাইনে ছিল ৮৮ হাজার ৩০৯ টন। সব মিলিয়ে এবারের রমজানে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ছোলা থাকবে।
মসুর ডালের সরবরাহ বেশি
বছরে মসুর ডালের চাহিদা সাত লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা থাকে এক লাখ টনের। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন এক লাখ ৬৯ হাজার টন। বছরে আমদানি করতে হয় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টন মসুর ডাল।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৫১ হাজার ৫৬১ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল এক লাখ ৯০ হাজার ৮৭ টন। এবার একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছে দুই লাখ দুই হাজার ৯৭২ টন। গতবার খোলা হয়েছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৩০৯ টন।
এবার আমদানির পাইপলাইনে আছে ৪৭ হাজার ২১০ দশমিক ১৪ টন মসুর ডাল। গতবার ছিল ৭২ হাজার ৫০১ দশমিক ৬৩ টন। সব মিলিয়ে গতবারের চেয়ে এবার বাজারে মসুরের ডালের সরবরাহ বেশি।
বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, চাহিদা কম বলে ছোলা-ডালের দাম এখনই নিম্নমুখী। বাজার স্থিতিশীল থাকবে রমজানেও।
কমবে খেজুরের দাম
গত বছর রোজার আগেই ইফতারিতে অন্যতম জনপ্রিয় উপকরণ খেজুরের শুল্ক কমানো হয়। এরপরে দামও বেঁধে দেওয়া হয়। তারপরও খেজুরের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সরকার। এ বছরও খেজুরে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে। এবার শুল্কছাড়ে আমদানি বেড়েছে।
‘কিছুদিন আগেই তেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এরপর পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আগে থেকেই কিছুটা কমতির দিকে। কোম্পানিগুলো সরবরাহ ঠিক রাখলে তেলের দামে আর সমস্যা হবে না।’ -বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা
চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজার ৮৮৩ টন খেজুর আমদানি করা হয়েছে। একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছে ৮৬ হাজার ১০৯ টন। পাইপলাইনে আছে আরও ৭৫ হাজার ২৫৮ টন খেজুর।
গত অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নয় হাজার ৬২৮ টন খেজুর আমদানি হয়েছিল। এলসি খোলা হয়েছিল ৪৮ হাজার ১৬৪ টন। পাইপলাইনে ছিল ৩০ হাজার ৫৯০ টন খেজুর। সব মিলিয়ে গতবারের চেয়ে এবার অনেক বেশি খেজুর থাকবে বাজারে। এ কারণে এবার খেজুরের দাম কমার সম্ভাবনা বেশি।
পাইকারি খেজুর ব্যবসায়ী ও ফল আমদানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর খেজুরের দাম অস্বাভাবিক বেশি ছিল। এবার বিশ্ববাজারে দাম কম, আমদানি বেশি। ফলে দাম কমবে।
বাজার কারসাজি নিয়ে শঙ্কা
নিত্যপণ্যের আমদানি ঠিক থাকলেও বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে কারসাজির কারণে প্রায় প্রতি রমজানে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি পর্যায়ে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবার রমজানে ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশলে বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকেন। এবারও নিশ্চয়ই তাদের এই অপচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে এটা থেকে যে ভোক্তা মুক্তি পাবে, তেমন কোনো কার্যক্রম দেখছি না। বাজার তদারকিতে এখনও দুর্বলতা রয়ে গেছে। আবার গত ৫ আগস্টের পরে দেশের অনেক নিত্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হাত গুটিয়ে আছে। সে ঘাটতি পূরণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্য যারা বাজারে আছেন, তাদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা সেভাবে হচ্ছে না। সে কারণে কারসাজি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার যে অস্থিতিশীল হবে না- সেটা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
ডলারের দাম নিয়ে ভয়
দেশে কিছুদিন আগেও হুট করে ডলার সংকট হয়েছিল। এখন কিছুটা ভালো অবস্থায় ফিরলেও অনেক ক্ষেত্রে সংকট রয়েই গেছে। এলসি খোলায় সমস্যা হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়লে পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়ে যায়, তাই এ বিষয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা যদিও ভাবছি, বাজার ঠিক থাকবে, তারপরেও ডলারের দাম কিন্তু বড় ভূমিকা রাখবে। ডলার যদি ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে থাকে তবে দাম ঠিক থাকবে। কিন্তু হুট করে বাড়লে সেটা নিশ্চয়ই বাজার অস্থিতিশীল করবে। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবেই।’
একই কথা বলেন টি কে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মো. শফিউল আতহার তাসলিম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারেও এই মুহূর্তে কোনো পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা নেই। তবে আমরা ঠিকমতো ডলার পাবো কি না সেটা নিয়ে চিন্তিত। ডলারের দাম ঠিক থাকলে পণ্যের দামে হেরফের হবে না।’