Image description

স্বাধীন বাংলাদেশে অষ্টমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ – ডাকসু নির্বাচন। সবশেষ ২০১৯ সালের বিতর্কিত ডাকসু নির্বাচনের ছয় বছর পর আয়োজিত এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন।

এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২০ হাজার ৮৭৩ জন এবং নারী ভোটার ১৮ হাজার ৯০২ জন।

পুরুষ ও নারী ভোটারের সংখ্যায় পার্থক্য খুব বেশি নয়; মোট ভোটারের অর্ধেকের কাছাকাছি নারী ভোটার।

আজ ৯ই সেপ্টেম্বর সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আটটি কেন্দ্রের ৮১০টি বুথে ভোটগ্রহণ চলবে।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে প্রতি ভোটার কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টি ও হল সংসদের ১৩টি পদ মিলিয়ে মোট ৪১টি পদে ভোট দেবেন।

ডাকসুর ২৮টি পদে দাঁড়িয়েছেন ৪৭১ জন প্রার্থী, যার মধ্যে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ৬২ জন। ২০১৯ সালের সাথে তুলনা করলে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। এরমধ্যে সহসভাপতি বা ভিপি পদেই দাঁড়িয়েছেন পাঁচজন নারী প্রার্থী।

১৮টি আবাসিক হলের হল সংসদে ১৩টি করে মোট ২৩৪টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ১০৮ জন।

ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল ঘোষণা করেছে দশটি সক্রিয় ছাত্র সংগঠন। ছাত্রদলের আবিদ-হামিম প্যানেল, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের 'বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ', ছাত্রশিবিরের 'ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট', বামপন্থি কয়েকটি সংগঠনের 'প্রতিরোধ পর্ষদ', উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে 'স্বতন্ত্র ঐক্যজোট', ছাত্র অধিকার পরিষদের 'ডাকসু ফর চেঞ্জ', ইসালামী ছাত্র আন্দোলনের 'সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ', বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মাহিন সরকারের স্বতন্ত্র প্যানেল 'ডিইউ ফার্স্ট' এবং তিনটি বাম জোটের 'অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪' প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এছাড়া অন্যান্য স্বতন্ত্র প্যানেলও রয়েছে।

নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোতায়েন করা হয়েছে দুই হাজারের বেশি সদস্যের বিশেষ বাহিনী।

সময় শেষ হবার পর তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হবে ভোট গণনা। থাকছে ভোটের ফলাফল সরাসরি এলইডি স্ক্রিনে প্রদর্শনের ব্যবস্থা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে বসে আছে শিক্ষার্থীরা
ছবির ক্যাপশান,আটটি কেন্দ্রের ৮১০টি বুথে ডাকসুর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

কোন হলের কেন্দ্র কোথায়

ডাকসু নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত আটটি কেন্দ্র হলো, কার্জন হল, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, সিনেট ভবন, উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজ, ভূতত্ত্ব বিভাগ এবং ইউল্যাব স্কুল এন্ড কলেজ।

এরমধ্যে কার্জন হল কেন্দ্রে ভোট দেবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অমর একুশে ও ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা।

শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে ভোট দেবে জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা।

টিএসসি কেন্দ্রে ভোট দেবে রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা, কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীদের ভোট কেন্দ্র ভূতত্ত্ব বিভাগ।

ইউল্যাব স্কুল এন্ড কলেজে ভোট দেবে শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থীরা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ভোট দেবে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা।

স্যার এ এফ রহমান, হাজী মুহম্মদ মুহসীন ও বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থীদের ভোটকেন্দ্র হলো সিনেট ভবন।

উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেবে সূর্যসেন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি জসীম উদদীন হলের শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ – ডাকসু ভবন
ছবির ক্যাপশান,প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখছেন ভোটাররা, প্রত্যাশা করছেন ব্যাপক পরিবর্তনের

৩৮তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার চার বছর পর থেকেই শুরু হয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের ভোট।

প্রতিবছরই এই নির্বাচন হবার কথা থাকলেও ১০৪ বছরের ইতিহাসে তা হয়েছে কেবল ৩৭ বার। এরমধ্যে ব্রিটিশ আমলে হয়েছে ১৪ বার, পাকিস্তান আমলে ১৬ বার আর স্বাধীন বাংলাদেশে সাত বার।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯র গণ-অভ্যুত্থান, ৭১'র মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর '৯০র নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখায় দ্বিতীয় সংসদ' হিসেবে পরিচিত ডাকসু।

অথচ ১৯৯১ সালের পর ২৮ বছর বন্ধ ছিল ডাকসু নির্বাচন। দুই যুগেরও বেশি সময় পর ২০১৯ সালে আয়োজিত নির্বাচনটিও ছিল বিতর্কিত।

হলের ক্যান্টিনে বসে খাবার খাচ্ছেন কয়েকজন
ছবির ক্যাপশান,১০০ বছরের পুরনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের থাকা, খাওয়ার মতো মৌলিক বিষয়গুলোও সমাধান করা যায়নি।

ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?

স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল ডাকসু নেতৃবৃন্দ, যার কারণে জাতীয় রাজনীতির বড় ক্যানভাসেই সাধারণত মাপা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে।

ফলে কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও, এই নির্বাচন শুরু থেকেই ছিল আলোচনার তুঙ্গে।

তবে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এর নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও, অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো তাতে ছিল অনেকটাই উপেক্ষিত।

১০০ বছরের পুরনো এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা, খাওয়ার মতো মৌলিক বিষয়গুলোরও সমাধান করা যায়নি। দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ও দখলদারিত্ব।

প্রশ্ন উঠছে, জাতীয় রাজনীতির বড় ক্যানভাসে যে নির্বাচনকে দেখা হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আসলে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর যে কয়টি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতিটিই ছিল বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে।

ফলে জাতীয় রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা যেমন সোচ্চার ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তারা প্রত্যাশিত সেই ভূমিকাটি পালন করতে পারেননি।

"আর এত বেশি তাদের জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যেতে হয়েছে যে ক্যাম্পাসের শিক্ষানীতি কিংবা শিক্ষার্থীদের যে বৃহত্তর অংশগ্রহণ বা এখানে যারা অংশীজন আছেন, যারা নীতি-নির্ধারণ করেন, তাদের বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে পাশে রেখে কীভাবে ডাকসুতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, সম্ভবত ওই সুযোগ তারা পাননি বা ওই চিন্তার জায়গাটাও তখন হয়তো অতটা অনুকূল ছিল না" বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

যদিও গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচনের পর ব্যাপক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

ডাকসু ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ১৯৮৯-৯০ সনে নির্বাচিত ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন
ছবির ক্যাপশান,১৯৮৯-৯০ সনে নির্বাচিত ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন

প্রত্যাশা পূরণ কতটা সম্ভব?

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণের বৈধ প্ল্যাটফর্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ - ডাকসু।

ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের বৈধ প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাবে, যারা শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া যথাযথ প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরতে পারবে। কিন্তু তা পূরণ করার ক্ষমতা থাকবে কর্তৃপক্ষের হাতেই।

১৯৮৯-৯০ সনের ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মুশতাক হোসেন। বলছিলেন, সেসময় ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা।

"সংসদতো কোনো কর্তৃপক্ষ নয়, তারা পরিবর্তনের জন্য দেনদরবার করবে, চাপ দেবে। দেখার বিষয় হলো তারা এটার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে কিনা", বলেন তিনি।

ডাকসু সচল না থাকার পরও সেসময় 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে আন্দোলনের পাশাপাশি "ছাত্রদের ডাইনিং হলের সমস্যা, পরিবহন সমস্যা সমাধান" করেছেন বলেও জানান ডাকসুর সাবেক এই জিএস।

অধ্যাপক শামীম রেজা বলছেন, প্রার্থীদের এবারের নির্বাচনি ইশতেহারেও "রাজনীতি বা বিশাল একটা চিন্তার প্রতিফলন বেশি দেখা গেছে – যেটা অনেকটা জাতীয় পর্যায়ের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরিভাগের"।

"তারপরও আমি মনে করি যে, এটা ইতিবাচকভাবে দেখা উচিৎ যে তারা চিন্তার পরিধি বিস্তৃত করছেন, হয়তো যখন এটা (ডাকসু নির্বাচন) নিয়মিতভাবে হবে, তারা নির্বাচিত হবেন- তখন বাস্তবতার নিরীখে তারা সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন", বলেন তিনি।