
তামাক যে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সেটি প্রমাণিত সত্য। তামাক একটি প্রাণঘাতী দ্রব্য। ধূমপায়ী ব্যক্তি যেমন এই ক্ষতির শিকার, তেমনি তার আশেপাশে যারা থাকেন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ধূমপায়ী হিসেবে তারাও এই ক্ষতির শিকার হন। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাশের বিকল্প নেই বলে জানান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
আপনরা (তরুণ) একত্রে বসে যখন সিগারেট খাচ্ছেন, একে-অপরকে কেন প্রশ্ন করছেন না এটা ভালো না। এখন মেয়েরাও খাচ্ছে। এটা কি আধুনিকতা বলে? এ ব্যাপারে আমাদের সকলকে সোচ্চার হতে হবে। তরুণ প্রজন্ম যদি একটা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে পারে, তাহলে এ বিষয়ে আপনাদেরও সচেতন হতে হবে। প্রতিবাদে নিজেদের ভেতর থেকে তৈরি করেন। তবেই আমরা আরও দায়িত্বশীল কাজ করতে সক্ষম হব। সব কিছু সরকারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। নিজেরা নিজেদেরকে সচেতন করলেই তামাকের কুফল থেকে রক্ষা পাবো। তাই সকলে সচেতন হতে হবে। শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে দিবেন না। আপনাদের সকালের রোল আছে, বিশেষ করে গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে তামাকের বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে।
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ডর্প আয়োজিত “জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাশের প্রয়োজনীয়তা” শীর্ষক এক জাতীয় সেমিনার প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম আরও বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষায় আমাদের সকলকে পাহারাদার হতে হবে। সকলকে দায়িত্ব নিতে হবে তামাকের বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। তোমরা দেশকে অনেক দূর নিয়ে এসেছো। তোমরাই আগামীর ভবিষ্যত। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাশের বিকল্প নেই। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে তামাক কোম্পানির মতামত নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে সময়ক্ষেপণ না করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী দ্রুত পাশের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার আহবান জানান তিনি।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ (প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জন) মারা যায় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অসুস্থ হয়। অথচ, তামাক কোম্পানিগুলো মুনাফার আশায় মিথ্যা প্রচার করে বলছে যে, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাশ হলে সরকার বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাবে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন ও ২০১৩ সালে সংশোধনের পর গত ১৮ বছরে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে সাড়ে ১২ গুণ। একই সঙ্গে ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এতে সুস্পষ্ট যে, তামাকের ব্যবহার কমলেও সরকারের রাজস্বে প্রভাব পড়ে না।
কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্টি’র সভাপতি ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি) মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া পর্যালোচনার জন্য গঠিত উপদেষ্টা কমিটি—এটি ডব্লিউএইচও এফসিটিসি’র আর্টিকেল ৫.৩ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ডব্লিউএইচও এফসিটিসি’র স্বাক্ষরকারী দেশ, আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিকে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখতে হবে। মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সরকারকে আমরা জোরালোভাবে বলা প্রয়োজন, তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণের এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাশ করতে হবে।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের মহাপরিচালক মোঃ আখতারউজ-জামান বলেন, তামাক আইন সংশোধনের বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মহোদয় চেষ্টা করে যাচ্ছেন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের জন্য। আপনাদেরকে গণমাধ্যম আমি বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারি। আপনারা হয়তো শুনেছেন- অতি সম্প্রতি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তামাকের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে সচেতন করা না গেলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন। অতএব, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার পেতে হবে জনস্বাস্থ্যের তামাক শিল্পের স্বার্থের নয় এবং তামাক শিল্পের মতামত নেওয়ার জন্য কোনো পরামর্শ সভা আয়োজন করা যাবে না। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এফসিটিসি ৫.৩ প্রতিপালনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত এই নীতিমালা লঙ্ঘনের কোন সুযোগ নেই।
সেমিনারে তামাক বিরোধী যুব প্রতিনিধি তাবাসসুম খানম রাত্রি এবং সবুর আহমেদ কাজল বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রির সাথে বসে তাদের মতামত গ্রহণ না করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাশ করতে হবে।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন ডর্প’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এএইচএম নোমান এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডর্প’র উপনির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান। উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য ডব্লিউএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল-এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রণীত খসড়ার সংশোধনীগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৬টি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। সেগুলো হলো- অধূমপায়ীদের সুরক্ষার জন্য সকল প্রকার পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা, তামাক পণ্যের প্রচার বন্ধ করার জন্য বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশু-কিশোর ও তরুণদের রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, তামাকপণ্যের সকল প্রকার খুচরা ও খোলা বিক্রয় বন্ধ করা ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা।
শীর্ষনিউজ