Image description

পতিত আওয়ামী সরকারের সময় দেশের অর্থনীতির আকার, মাথাপিছু আয়, রফতানি আয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচককে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বয়ান তৈরি করা হয়েছিল।পতিত আওয়ামী সরকারের সময় দেশের অর্থনীতির আকার, মাথাপিছু আয়, রফতানি আয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচককে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। স্বৈরশাসনকে বৈধতা দিতে এ বয়ান সামনে আনা হয়েছে নানাভাবে। সরকারের অতিরঞ্জিত এসব তথ্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পরিবর্তে সে সময় এর সঙ্গে তাল মেলাতে দেখা গেছে বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলোকে। এমনকি এসব সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মিরাকল বলেও অভিহিত করা হয়েছিল। যদিও এ ‘মিরাকলের অর্থনীতি’ গত তিন বছরে ধসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এ ধস ঠেকাতে আবার এমনই এক বহুজাতিক দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এজন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে দেশের অর্থনীতিতে নানা সংস্কারের প্রেসক্রিপশন ও লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও এসব প্রেসক্রিপশন অনুসরণ ও লক্ষ্যপূরণ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। যদিও আইএমএফসহ বহুজাতিক এসব দাতা গোষ্ঠীগুলোর পরামর্শে দেশে অতীতে যেসব সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলো কার্যকর সুফল বয়ে আনতে পারেনি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, স্থানীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ধার করা এসব পরামর্শে কখনই কাঙ্ক্ষিত সুফল আনা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফের সম্পর্ক স্বাধীনতার পর থেকেই। এখন পর্যন্ত ১০ বার সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এসব ঋণের বিপরীতে সংস্থাটির পরামর্শে বিভিন্ন সময়ে দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে নানা সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতেও বিভিন্ন সংস্কার করেছে সরকার। তবে এতসব সংস্কারের পরও দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়েছে।আইএমএফের তথ্য বলছে, প্রায় প্রতি দশকেই বাংলাদেশ সংস্থাটির কাছ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় ঋণ নিয়েছে। ১৯৮৬ সালে সংস্থাটি কাঠামোগত সমন্বয় সুবিধা (এসএএফ) নামে একটি আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি তৈরি করে। এর পরের বছরই বাংলাদেশ সেটি গ্রহণ করে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচির অধীনে ২০ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার এসডিআর (আইএমএফের নিজস্ব মুদ্রা) নেয়া হয়। ১৯৮৭ সালে আইএমএফ বর্ধিত কাঠামোগত সমন্বয় সুবিধা (ইএসএএফ) চালু করে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল মেয়াদে ইএসএএফের আওতায় ৩৩ কোটি এসডিআর গ্রহণ করে বাংলাদেশ। আইএমএফের দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সুবিধা (পিআরজিএফ) কর্মসূচির অধীনে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল মেয়াদে নেয়া হয় আরো ৩১ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার এসডিআর। বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) আওতায় ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল মেয়াদে ৬৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার এসডিআর নেয়া হয়েছে। কভিডের সময়ে ২০২০ সালে সংস্থাটির কাছ থেকে ৫৩ কোটি ৩৩ লাখ এসডিআর পায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় ২০২৩ থেকে ২০২৬ সাল মেয়াদে ৪২৫ কোটি এসডিআর অর্থায়ন সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে।আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রথম ঋণ সহায়তা নেয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে সংস্থাটির কাছে পাঁচবার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি ও স্বৈরশাসনের সময়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি না হওয়ায় সে সময় বাংলাদেশকে ঋণের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়েছে, যার কারণে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।

 

দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের উত্থান ঘটে নব্বইয়ের দশকে। এর ধারাবাহিকতায় স্থানীয় উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি রফতানিতেও সাফল্য আসে। বিকশিত হতে থাকে অর্থনীতি। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। পাশাপাশি ১৯৯০ সালে আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতেও সরকারের ওপর বেশকিছু সংস্কারের শর্তারোপ করা হয়। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) চালু করা, বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে আমদানি শুল্ক হ্রাস ও দেশের ব্যাংক খাতে সংস্কারের শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। এসব সংস্কারের সঙ্গে আইএমএফের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকও সম্পৃক্ত ছিল।আইএমএফের এসব ঋণ কর্মসূচির বিপরীতে অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আশির দশকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে এর মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত যে সুফল পাওয়ার কথা ছিল তা আসেনি। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করা হলেও এখনো দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। বিশেষ করে কভিড ও জেঁকে বসা উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে দারিদ্র্য আরো বেড়েছে। দেশের ব্যাংক খাতের সংস্কারে উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শে অনেক সংস্কার করা হয়েছে। যদিও এর সুফল নেই ব্যাংক খাতে। বরং দিন দিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দশা আরো করুণ হয়েছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর সমস্যাও আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন আরো স্ফীত হয়েছে। গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থ আদায়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ব্যাংক খাত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো বা এতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার প্রয়াস কখনো অতীতে সফল হতে দেখা যায়নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশেই এসব কর্মসূচির সুফল আসেনি। এর কারণ হচ্ছে নিজস্ব চিন্তাভাবনার পরিবর্তে অন্যের চিন্তা অনুসারে সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এটা বলা হয়ে থাকে যে সংস্কার নিজ দেশের মধ্য থেকেই আসতে হবে তা না হলে এটি ফলপ্রসূ হবে না। বিভিন্ন দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। ফলে এক দেশে যেটা খাটবে সেটি আরেক দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই নিজেদের বাস্তবতা অনুসারে অর্থনীতিতে কোন ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সেটি নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে কী ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, সেটি আমাদেরই ঠিক করা উচিত। প্রয়োজনে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা অন্য কেউ যদি সহায়তা করতে চায়, সেটি নেয়া যেতে পারে। আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশের বাস্তবতা আমাদের চেয়ে বেশি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কোন সংস্কার আগে করতে হবে আর কোনটি পরে কিংবা কোন পদ্ধতিতে সংস্কার করতে হবে, সেটি আমরাই সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারব। আইএমএফ রাজস্ব আয় বাড়াতে বলেছে, সেজন্য আমরা মূসক ও শুল্ক আরোপ করেছি। কিন্তু শুধু করহার বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। বরং এতে ফাঁকির প্রবণতা আরো বাড়বে। কর আদায়ে অক্ষমতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করা গেলে বর্তমানে যা আদায় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হতো। সংস্কার কঠিন কাজ। তাই আমরা সহজ পথে হাঁটছি। এটি হলো আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকও মূল সমস্যা সম্পর্কে অতটা ভাবে না, তারা বলে যেভাবে পার, কর। এতে সমস্যার সমাধান অতীতে হয়নি। এখনো হচ্ছে না। ভবিষ্যতেও হবে না। তাদের দেয়া অর্থও কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। নিজেদের সমস্যাগুলো আমরা সমাধান করতে পারলে সামান্য এ অর্থের জন্য এসব সংস্থার কাছে যেতে হতো না।’

১৯৯০ সালে নেয়ার পর এক দশকের বেশি সময় আইএমএফের কাছে আর ঋণ চায়নি বাংলাদেশ। এর পর সংস্থাটির কাছে ঋণ চাওয়া হয় ২০০৩ সালে। সে সময় বহুজাতিক সংস্থাটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমানোর শর্ত দেয়া হয়েছিল। তখন আইএমএফের শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। এ নিয়ে সে সময়ে তৎকালীন সরকারকে বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।আইএমএফের নীতি অনুসরণে সমস্যা হলে সেটিকে নিজেদের সুবিধা অনুসারে বাস্তবায়নে সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইএমএফের একটি মিশন এসেছিল বাংলাদেশে। সে সময় দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকাঠামো, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক খাত, জ্বালানি খাত, সুশাসন ও বাণিজ্য উদারীকরণের মতো বিষয়গুলোয় সংস্কারের কথা বলেছিল আইএমএফ। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলোও জড়িত ছিল।সে সময় আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাস্তবতা অনুসারে কীভাবে নীতি বাস্তবায়ন করা হলে সবচেয়ে ভালো হবে সেটিই আমাদের করতে হবে। যদি মনে হয় যে আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করলে আমাদের জন্য সমস্যা হবে, সেটা তাদের বোঝানো হলে তারা বুঝবে। তারা কথা শুনতে আগ্রহী না, এমন তো নয়। কোনো বিষয়ে যদি আইএমএফের সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের মতপার্থক্য থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মতৈক্যে আসা যেতে পারে। আমি দায়িত্বে থাকার সময় আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের শর্ত আরো নমনীয় করতে পেরেছিলাম। আইএমএফের পরামর্শে সমস্যা নেই। সমস্যা রয়েছে আমাদের বাস্তবায়ন সক্ষমতায়। আইএমএফের অনেক পরামর্শ কাঙ্ক্ষিত বলে আমি মনে করি। যেমন তারা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হার আরো নমনীয় করার কথা বলে থাকে, যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে। ব্যাংক খাতের সংস্কারের পরামর্শ তারা দিয়েছে, এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু কিছু তো হচ্ছে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য সরকারের দিক থেকে শর্ত পূরণের তাগাদা থাকে। এক্ষেত্রে প্রকৃত সংস্কারের চেয়ে মূলত কোনো রকমে শর্ত পূরণ দেখিয়ে ঋণ ছাড় করানোটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। ঋণ নেয়ার পর আবারো পুরনো চর্চাতেই ফিরে যেতে দেখা যায়। ফলে নামকাওয়াস্তের সংস্কারে কোনো সুফল মেলে না। বহুজাতিক সংস্থার পরামর্শ অনুসারে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছিল। কিন্তু এতে কোনো সুফল তো আসেইনি বরং উল্টো বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। সরকারের কাছ থেকে মূলধন সহায়তা ছাড়া ব্যাংকগুলোর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব এবং মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। অর্থ বিভাগে থাকাকালীন তিনি আইএমএফের পরামর্শ ও সরকারের নীতি বাস্তবায়নের বিষয়টি কাছ থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক কিংবা এ জাতীয় বহুজাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সংস্কারের যেসব পরামর্শ দেয়া হয় সেগুলোকে আমরা আত্তীকরণ করি না, বরং তাদের আরোপিত শর্ত হিসেবে দেখে থাকি। এসব শর্ত বাস্তবায়ন দেখিয়ে তহবিল ছাড় করার পর আবারো আগের জায়গায় ফিরে যাই। যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এগুলোকে লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছিল। কিন্তু এর ধারাবাহিকতায় সংস্কার কার্যক্রমকে গভীর করার জন্য আরো যেসব উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল সেগুলো করা হয়নি। আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে এর অনেকগুলো তো আমাদের নিজেদেরই করার কথা। কিন্তু আমরা ঋণ পাওয়ার জন্য কোনো রকমের শর্ত বাস্তবায়ন করে পরে আবারো পুরনো জায়গায় ফিরে যাই। ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে সংস্কার না করে প্রেসক্রিপশন অনুসারে সংস্কার করা হলে শেষ পর্যন্ত টেকসই কোনো ফল পাওয়া যায় না এবং যাচ্ছেও না।’

বহুজাতিক সংস্থাগুলো একদিকে সরকারকে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে গেছে, অন্যদিকে সরকারের উন্নয়নের বয়ানকে সমর্থন দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশের জিডিপি, মাথাপিছু আয়, রফতানি আয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অতিরঞ্জিত তথ্য দেখানো হয়েছিল। বহুজাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এসব অতিরঞ্জিত তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করার পরিবর্তে এসব তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর উত্থানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে মিরাকল বলে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে এই মিরাকলের বুদবুদ ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নানামুখী সংকটে দেশের অর্থনীতির রুগ্‌ণ চেহারাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।২০২২ সালে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দ্বীপদেশ শ্রীলংকা। অসহনীয় মূল্যস্ফীতির চাপে নাভিশ্বাস উঠে যায় দেশটির মানুষের। জ্বালানি ও রিজার্ভ সংকটে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় দেশটি। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় দেশটি। শ্রীলংকার মতো চরম পর্যায়ে না গেলেও একই বছর থেকেই সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকটের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশও। মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্তের পাশাপাশি রিজার্ভ সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও নাজুক অবস্থানে ঠেলে দেয়। সে সময় বাংলাদেশও কি শ্রীলংকা হয়ে যাচ্ছে, দেশব্যাপী এমন জল্পনা শুরু হয়। এ অবস্থায় সংকট কাটাতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। এ ঋণের বিপরীতে শর্ত হিসেবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বিনিময় হার নমনীয় করা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, ব্যাংক খাতের সংস্কারসহ নানা শর্ত জুড়ে দেয় আইএমএফ। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আইএমএফের কাছে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাড়তি অর্থ চাওয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি আরো অতিরিক্ত ৭৫ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে, যা সামনের মাসে সংস্থাটির পর্ষদে অনুমোদনের পর চূড়ান্ত হবে। অবশ্য বাড়তি এ ঋণের বিপরীতে আরো বেশকিছু শর্ত পালন করতে হবে। আইএমএফের শর্তানুসারে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি শতপণ্যের মূসক ও শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।