
বিশিষ্ট সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাস একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ যেখানে এক বেকার যুবক শ্যামের গল্প বলা হয়েছে। এই উপন্যাসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। উপন্যাসের প্রথম চরিত্র শ্যাম চক্রবর্তী। যিনি বিক্রমপুরের বনিখাড়া গ্রামের বাসিন্দা। শ্যাম একটি বেসরকারি ফার্মে ছোট সাহেবের কাজ করতেন, কিন্তু একটি সামান্য কারণে চাকরি ছেড়ে দেয়। এরপর বেকারত্ব আর অনিশ্চিত জীবন তাকে ঘিরে ধরে। লেখক যখন বইটি লিখছিলেন তখন বইয়ের নাম বিবেচনায় (শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র) লেখা ‘সত্যানুসরণ’।
বই খুলে প্রথম যে শব্দটি চোখে পড়েছিল, সে শব্দটি দিয়েই ‘ঘুণপোকা’ নামটি বেছে নেন। ঠিক তেমনি বিশিষ্ট্য সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গল্পের মতোই ইকবালের জীবন। যিনি ঘুণপোকার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন চিত্র। কাঠের আসবাবে যখন ঘুণ ধরে, তখন মন খারাপের অন্ত থাকে না। অথচ ঘুণে কাটা কাঠের গুঁড়া দিয়ে সুন্দর সব চিত্রকর্ম এঁকে যাচ্ছেন ময়মনসিংহ নগরের কাঁচিঝুলি এলাকার ইকবাল হোসেন ওরফে মোহন আকন্দ (৪৬)। নিজেকে তিনি বলেন, ‘ঘুণশিল্পী’ হিসেবেই পরিচয় দেন। তাঁর আঁকা ছবি যায় ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
অভাব-অনটনের সংসারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ইকবালের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। জীবিকার তাগিদে তিনি চুমকি, জরি, কটনবাড, দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ওয়ালম্যাট তৈরির কাজ শেখেন। সেগুলো তৈরি করে বিক্রি করতেন। পরে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একজন ‘ঘুণশিল্পী’।
ময়মনসিংহের জেল রোডে কাঁচিঝুলি এলাকার সড়কের পাশে ইকবালের ছোট ছাপড়ার নার্সারি রয়েছে। চার বছর আগে এই নার্সারি করেছেন। টিনশেডের ছোট্ট ছাপরাঘরেই তাঁর আঁকার জগৎ। দিনভর গাছ বিক্রি করেন আর ক্যানভাসে ঘুণে কাটা কাঠের গুঁড়া দিয়ে ছবি আঁকেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর ‘ঘুণশিল্পী নার্সারি’ নামের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, নতুন একটি ছবি আঁকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সে জন্য সংগ্রহ করে আনা গুঁড়া চালুনি দিয়ে চেলে নিচ্ছেন। ময়লাগুলো আলাদা করে পরিষ্কার গুঁড়া সংরক্ষণ করছেন।
কথায় কথায় ইকবাল জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বাসাবাড়ি থেকে ঘুরে ঘুরে ঘুণে কাটা গুঁড়া সংগ্রহ করেন তিনি। এরপর কাগজের বোর্ডে কালো কাপড় লাগিয়ে ক্যানভাস তৈরি করে তাতে পেনসিল দিয়ে কাঠামো আঁকেন। তারপর সেখানে আঠা লাগিয়ে তার ওপর ঘুণের গুঁড়া ছড়িয়ে দিয়ে শুকিয়ে নেন। এভাবে ভেসে ওঠে নান্দনিক প্রতিচ্ছবি।
ছবি আঁকার বর্ণনা শুনিয়ে ইকবাল হোসেন বলেন, ১৯৯৮ সালের দিকে এক বন্ধুর বাসা পরিবর্তন করার সময় খাটের নিচে পড়ে থাকা ঘুণে ধরা কিছু কাঠের গুঁড়া সংগ্রহ করি। যেহেতু জরি ও চুমকি দিয়ে ওয়ালম্যাট হয়, তৎক্ষণাৎ ভাবেন এই গুঁড়া দিয়েও হবে। কিছু দিনের চেষ্টায় সেই কাঠের গুঁড়া আঠার সাহায্যে কাপড়ে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেন এক ধরনের ওয়ালম্যাট। এর পর থেকে তিনি একের পর এক আকর্ষণীয় ওয়ালম্যাট বানিয়ে চলেছেন।
ইকবালের ছোট্ট ছাপরাঘরে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রিটেনের প্রয়াত রানী এলিজাবেথের ছবি, পাখি, ফুল প্রকৃতিসহ নানা দৃষ্টিনন্দন ছবি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ঘুণ দিয়ে ছবি আঁকায় এখন গুঁড়ার অভাব হয় না। পরিচিতজনরাই দিয়ে যান কিংবা তিনি নিয়ে আসেন। পরে সেগুলো পরিষ্কার করে বোতলে সংগ্রহ করেন। ছবিতে মূলত দুই ধরনের গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে ভালো ছবি হয় মেহগনি, কাঁঠাল ও কেরোসিন কাঠের গুঁড়ায়। সব কাঠের গুঁড়ার রংও এক রকম নয়। তবে একটি দৃশ্য আঁকতে সাদা ও মলিন দুই ধরনের গুঁড়ারই প্রয়োজন পড়ে।
ইকবাল হোসেন বলেন, কাপড়ে আঠা দেওয়ার কাজটি করতে হয় খুব সাবধানে। আঠা এলোমেলো হয়ে গেলে কাঠের গুঁড়া এলোমেলো হয়ে যাবে। পুরো শিল্পকর্মটিই নষ্ট হয়ে যাবে। ওয়ালম্যাটগুলো বাঁধাই করে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো প্রদর্শনীও করেন। পরে নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যানে আরও কয়েকটি প্রদর্শনী করেছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ভিশনের মাধ্যমে কিছু ছবি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গেছে। নার্সারি আর ছবি বিক্রির আয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলেদের লেখাপড়া এবং সংসার ভালোভাবেই চলে যায় তাঁর।
ইকবালের দোকানে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ফুহাদ হাসান, আবুল হাসেন ও মাসুদ করিম। তারা বলেন, ‘ফেলে দেওয়া জিনিসও যে মূল্যবান, তা কখনো দেখি নাই। আজ ইকবালের কাজ থেকে শুনে মনে হলো প্রত্যেকটা মানুষের মেধা ও মননে ইবকালের মতোই কাজ করা উচিত। ইকবাল বলেন, যদি সরকারের কোনো সহায়তা পাই তা হলে আমি আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারব। তিনি আরও বলেন, সমাজের বিত্তবানরা যদি এসে তাদের ওয়ালম্যাট তৈরির করার অনুমতি দেয় সেটাও আমি করতে চেষ্টা করব।