Image description
 

কখনও মোসা. শাহানাজ আক্তার, কখনও মো. শাহানাজ আক্তার মুন্নি। এভাবে নাম পরিবর্তন করে এক ব্যক্তি দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দুই এনআইডি দিয়ে চাকরিও নেন এই শাহানাজ মুন্নি। সেখানেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রথমে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কেবিন ক্রু ছিলেন। বর্তমানে তিনি ফ্লাইনাসা নামে একটি বিদেশি এয়ারের কেবিন ক্রু। অভিযোগ রয়েছে, চাকরিতে তিনি যেসব সনদ জমা দিয়েছেন, সেগুলোও বানানো। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ আমাদের সময়ের হাতে রয়েছে। শুধু শাহানাজ মুন্নি নয়, এর আগে আলোচিত চিকিৎসক সাবরিনা আক্তারেরও একাধিক এনআইডি নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এনআইডির প্রক্রিয়াগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এমনটি হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত পাঁচ আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করা যেত। কারও অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে প্রথমে যে পাঁচ আঙুলের ছাপ দিয়ে এনআইডি নিয়েছেন; পরে অন্য হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে তিনি আবার অন্য নামে নিতে পারতেন। ২০১৯ সালের পর দশ আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে কেউ পায়ের আঙুলের ছাপ দিলেও যন্ত্র ধরার সক্ষমতা রাখে না।জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে দুটি এনআইডি বানানোর বিষয়ে জানতে শাহানাজ মুন্নির ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার মোবাইল ফোনে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। সেই বার্তারও জবাব দেননি মুন্নি।শাহানাজ মুন্নির এনআইডি জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইকরামুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই করে আমরা এর সত্যতা পেয়েছি। তখনই এনআইডি সার্ভার থেকে তার দুটি এনআইডি ব্লকড করে দেওয়া হয়। বর্তমানে দুটিই ব্লকড রয়েছে।

এ বিষয়ে গুলশান থানায় ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট একটি মামলা দায়ের করেন থানা নির্বাচন কর্মকর্তা ইকরামুল হাসান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই মামলায় একবার শাহানাজ মুন্নিকে আটক করা হয়। তবে ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতায় তিনি ছাড়া পেয়ে যান।মামলার বিষয়ে জানতে গুলশান থানায় যোগাযোগ করা হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালে। বর্তমানে আসামি কী অবস্থায় রয়েছে, আদালত বলতে পারবেন। বিগত সরকারের সময়ে চার্জশিট জমা দেওয়ার পর তখনকার পিপি অদৃশ্য কারণে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছেন।

জালিয়াতির প্রমাণ মেলে যেভাবে:

পিতা-মাতার নাম অপরিবর্তিত রেখে শাহানাজ মুন্নির নামে দুটি ভিন্ন জন্মনিবন্ধন পাওয়া গেছে। তার এইচএসসির মার্কশিটে যে জন্মতারিখ রয়েছে, তার সঙ্গে এনআইডিতে ব্যবহৃত জন্মতারিখের মিল নেই। শিক্ষাগত সনদে মুন্নি নামটি থাকলেও এনআইডি সার্ভারে সেই তথ্য নেই। আবার ২০০৮ সালে এনআইডি করার সময় তিনি বিবাহিত বলে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তার স্বামীর নাম মো. ফজলুর রহমান সজল। কিন্তু ২০১৬ সালের তথ্য সারণিতে দেখা গেছে তিনি অবিবাহিত। স্বামী থাকার পর বিচ্ছেদ হলে সেখানে বিপত্নীক বা বিধবা উল্লেখ থাকে। কিন্তু শাহানাজ মুন্নি নিজেকে অবিবাহিত উল্লেখ করে এনআইডি নিয়েছেন।

মোসা. শাহানাজ আক্তারের এসএসসির দুটি সনদ আমাদের সময়ের হাতে এসেছে। যাচাই করে দেখা গেছে, তিনি একটি সনদের ওপর কলম দিয়ে কেটে নিজের চাহিদামতো ফল চেয়েছেন। সেই অনুযায়ী পরে সনদ নিয়েছেন। সেখানে এসএসসির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঠিক রেখে প্রথমে শিক্ষাবর্ষ ১৯৯৬-৯৭ উল্লেখ করা হয়। সেই সনদে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরে শিক্ষাবর্ষ-২০০৪ উল্লেখ করে একই নামে আরেকটি সনদ নেন শাহানাজ আক্তার। সেখানে পরীক্ষার বছর উল্লেখ করা হয় ২০০৬। ওই সনদে তিনি জিপিএ-৪.৮২ উল্লেখ করেন। আবার দুই সনদে দুজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষর পাওয়া যায়। একইভাবে তার এইচএসসি পাসেরও দুটি সনদ রয়েছে। প্রথমে ২০০০ সালের অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ বলে সনদ নেন। এরপর ২০০৮ সালে তার নামে আরেকটি এইচএসসি সনদ পাওয়া যায়, সেখানে তিনি জিপিএ ৩.৪৫ পেয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। এভাবে তিনি শিক্ষাগত সনদও জালিয়াতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কারও একাধিক এনআইডি থাকলে আইনে তিনি অপরাধী। এ বিষয়ে আইনে উল্লেখ রয়েছে, কোনো নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্রপ্রাপ্তির লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রদান করলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। এ জন্য শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র নিলেও শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড।

শাহানাজ আক্তার মুন্নি কখন কীভাবে তথ্য দিয়েছেন:

১৯৯০ সালে জন্ম নিয়ে ১৯৮৩ সালের পরিচয় দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নেন তিনি। এতে মোসা. শাহানাজ আক্তার, পিতা আবদুস সালাম, মাতা রহিমা বেগম। স্থায়ী ঠিকানা-তালুকদার বাড়ী, গ্রাম গোবার্ঝন, ওয়ার্ড-০৬, গৌরনদী পৌরসভা, থানা গৌরনদী, জেলা বরিশাল- এসব তথ্য রয়েছে। তিনি ২০০৯ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের আওতায় থানা নির্বাচন অফিস গুলশান হতে ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করেন, যার এনআইডি- ১৯৮৩২৬৪০৪৫৭০০০০২৭/৭৭৫৮০৪৬২৫৯। পরে ২০১৭ সালের হালনাগাদ কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল ভোটার হওয়ার জন্য চার আঙুলের ছাপসহ বায়োমেট্রিক ও অন্যান্য তথ্য প্রদান করেন। অভিযুক্তের ডাটাবেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি জন্মতারিখ, বৈবাহিক স্ট্যাটাস এবং বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানাসংক্রান্ত তথ্যাদি পরিবর্তন করে নতুনভাবে ভোটার নিবন্ধন করেছেন। এ ছাড়াও ২০২১ সালের নভেম্বরে তার নিজ নাম সংশোধন (মোসা. শাহানাজ আক্তার মুন্নির পরিবর্তে মোসা. শাহানাজ আক্তার) করেছেন। এর পর একই বছরের ডিসেম্বর তার জন্মতারিখ সংশোধন করে ৭ ডিসেম্বর ১৯৯০-এর পরিবর্তে ১০ অক্টোবর ১৯৮৩ করতে আবেদন করেন। ২০০৯ সালে তিনি বিবাহিত উল্লেখ করেন। তার স্বামীর নাম মো. ফজলুর রহমান সজল। কিন্তু ২০১৭ সালে তিনি নিজেকে অবিবাহিত উল্লেখ করে এনআইডি নেন। তিনি ভোটার তালিকা আইন ২০০৯-এর ধারা ১৮ অনুসারে ভোটার তালিকা সংশোধন সম্পর্কে মিথ্যা উপস্থাপন করেছেন এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০-এর ধারা ১৪ অনুসারে মিথ্যা তথ্য প্রদান ও ১৫ অনুসারে একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণের অপরাধ করেছেন।