
Sabina Ahmed ( সাবিনা আহমেদ)
আজ অমি পিয়াল ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলকে পুরো প্যানেল হিসেবে জয়ী করার আহ্বান জানিয়েছে। পোস্টটা দেখে আমার মুখ তিতা হয়ে গেছে। লীগের সবচেয়ে ঘৃণিত ফেসবুকার হয়ে ছাত্রদলের জন্য পোস্ট করা—কোনও স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী, তারা খুশি না হলেও বিএনপির নব্য সেক্যুলাররা কিন্তু অখুশি নয়। তারা এটাই চেয়েছিল। এদের জন্যই বলা হয়, “দুই সাপের এক বিষ!”
কারা আজকের বিএনপির নব্য সেক্যুলার? এরা তারাই যারা সব ডানপন্থীকে জামায়াত-শিবির ক্যাম্পে ঢোকায়। এদের কাছে সেক্যুলারিজম মানে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং ইসলামবিদ্বেষ। এরাই এখন বিএনপির নীতি নির্ধারণের চেষ্টা করছে। এরা বামপন্থী, বামপন্থী-ঘেঁষা, কেউই সেন্ট্রিস্ট নয়।
বিএনপি এখন আর জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীর দল নয়—যা ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণ করে ‘আল্লাহর প্রতি পরম বিশ্বাস’ যুক্ত করেছে। না বেগম জিয়ার ডানের বাম-বামের ডানের দল। এটি এখন পুরোপুরি ইসলামোফোব সেকুলার আর বামদের খপ্পরে পড়া আদর্শহীন একটি দল।
আমি অনেক ইনটেলেকচুয়াল ডানপন্থীকে চিনি, যারা ছাত্রজীবনে বিএনপি করেছে, এখন বলে: “এই বিএনপি আমার নয়।” এক-দু’জন নয়, অনেকেই। এদের ক্রেডেনশিয়াল বিএনপির টপ ০.০১%-এর মধ্যে। এদের এক্সপার্টিজের ধারেকাছে পড়ে না মিডিয়ায় বকবক করা নব্য সেকুলার বিএনপি অ্যাকটিভিস্টস । এরা রাজনৈতিক মতভেদের কারণে জামায়াত নয়, কিন্তু আদর্শিক অনৈক্যের কারনে আজকের বিএনপিকে আর ওন করতে পারছে না। ফলে বিএনপি থেকে ডানপন্থী মেধাবিরা দূরে সরে গেছে।
বিএনপি এর নব্য সেকুলার লিডাররা দলের যা লাভ করছে, দেশ ও দলের ভবিষ্যতের ক্ষতি করছে তার বহুগুণ। এরা ৫ ই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের গ্রুপ আর লিস্ট থেকে সব ডানপন্থীদের বাদ দিয়েছে। এদের বেশ ইনফ্লুয়েনশিয়াল একজনের “হিটলিস্ট” আছে—সেই লিস্টে যাদের নাম, তাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় কমেন্ট দেখলেই সে লাইক মারে। যা প্রকাশ্যে ডানপন্থীদের বিরুদ্ধাচরণকে উস্কে দেয়।
গত ১৭ বছর এই সেকুলাররা সেন্ট্রিস্ট আর ডানপন্থীদের সঙ্গে হাসিনাবিরোধী লড়াইয়ে পাশাপাশি ছিল। একই গ্রুপে কাজ করেছে, একসঙ্গে আলোচনায় বসেছে, একসঙ্গে হেঁটেছে। কিন্তু ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর এদের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। এরা শিবিরকে বলে গুপ্ত, কিন্তু আমি দেখি এরাও গুপ্ত ছিল—আসল চেহারা লুকিয়ে ডানপন্থী সেজে কিংবা নিরপেক্ষতার ভেক ধরে হাসিনাবিরোধী অ্যাকটিভিজম করেছে। এখন খোলামেলা ডানবিরোধী। এই কারণে অমি পিয়াল ভাবছে, “এরা তো আমার মতোই, তাহলে ছাত্রদলকেই প্রমোট করি ।”
ইউনিভার্সিটির হলে থাকার জন্য কিছু ছাত্র যদি নিজেদের শিবির পরিচয় লুকিয়ে ছাত্রলীগের বৈঠকে যেতে বাধ্য হয়, আর এখন তার জন্য গুপ্ত ট্যাগিংয়ের শিকার হয়, তাহলে বিএনপির এই চরমপন্থী নব্য সেক্যুলারদের কেন “সুপার গুপ্ত” বলা যাবে না? অবশ্যই বলা যাবে। শিবির অন্তত সারভাইভালের জন্য পরিচয় গোপন করেছে, এরা তো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য।
জুলাইয়ের আন্দোলন ছিল জাতীয় ঐক্যের অসাধারণ উদাহরণ, যা দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে সবাইকে এক করেছে। ফলে হাসিনা ৫ আগস্ট পালিয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লুকিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপর শুরু হয়েছে ডান ও বামের টানাপোড়েন। মাত্র কয়েকদিন আগেও তারা এক হয়ে লড়েছে, কিন্তু লড়াই শেষ হতে না হতেই নব্য সেক্যুলার বামশক্তি স্থির করল: দেশের পুনর্নির্মাণ তারা একাই করবে, ডানপন্থীরা তাদের প্রজা হয়ে থাকবে।
শিক্ষিত নিও-সেকুলার ইসলামহেটাররা ভাবল, এবার তাদের সময় এসেছে। যারা ইসলামের কথা বলে বা ধর্মের প্রতি সফট হার্ট রাখে, তাদের কণ্ঠ রোধ করতে হবে। এসব কণ্ঠ জাতির জন্য অ্যাসেট হলেও, কথা বলার স্পেস দেওয়া যাবে না। দরকার হলে স্বৈরাচারীদের সঙ্গে মিলে কাজ করবে, কিন্তু ডানপন্থীদের দূরে রাখবে।
এই দর্শন আসলে সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং আদর্শিক সাম্রাজ্যবাদ—যা ধর্মীয় সহাবস্থানের পরিবর্তে দমনকে প্রচার করে। এটি গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ—স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদের—বিপরীত।
এই দার্শনিক পার্থক্য উদারবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে সংঘাত করে। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, সত্যের খোঁজে বিভিন্ন মতামতের সংঘর্ষ দরকার, কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা অন্যকে দমন করলে সমাজের বৌদ্ধিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পার্থক্য আরও গভীর। স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি উভয়ই ভূমিকা রেখেছে—১৯৭১-এ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ সবাই এক হয়েছে। কিন্তু পরে জিয়াউর রহমানের ১৯৭৭-এর পঞ্চম সংশোধনীতে ‘আল্লাহর প্রতি পরম বিশ্বাস’ যুক্ত করে ধর্মীয় পরিচয়কে জাতীয়তাবাদের অংশ করা হয়েছে, যা বামপন্থীদের কাছে সেকুলারিজমের বিরোধী মনে হয়। কিন্তু দার্শনিকভাবে এটি অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর সঙ্গে মিলে যায়—ধর্মীয় মূল্যবোধ সমাজের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এর দমন শূন্যতা সৃষ্টি করে, যা নিও-ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানকে সহজ করে।
বাম আর নিও-সেকুলারদের ধর্মভীরু লোক দেখলে গায়ে চুলকানি হয়। এরা মানুষকে মেধা, কর্মক্ষমতা দিয়ে বিচার করে না— বিচার করে এরা ইসলামিক কি না, অর্থাৎ ডানপন্থী কি না। ফলে এদের চারপাশ ভরে গেছে মিডিওকার অদক্ষ লোকজনে, যাদের আমি ‘ছাপড়া’ বলি। এদের ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষকে পশ্চাদপদ করে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধই সমাজের স্থিতিশীলতা ও নৈতিকতার ভিত্তি। এটি উপেক্ষা করলে জাতীয় ঐক্য ভেঙে পড়ে। উদাহরণ: ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে বাম-ডানের ঐক্য এরশাদের পতন ঘটিয়েছে, কিন্তু পরে বিভেদের কারণে অস্থিরতা বেড়েছে—যা ২০০৯-এর পর আওয়ামী লীগের একনায়কত্বকে সহজ করেছে।
এই দার্শনিক বিভেদ এখন জাতিকে বিভক্ত করছে, সামাজিক ফ্যাব্রিক ছিন্নভিন্ন করছে। বামপন্থীরা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ‘পশ্চাদপদ’ বলে উপেক্ষা করলে, ডানপন্থীরা অবহেলিত বোধ করে। এই বিভেদ আবারও নিও-ফ্যাসিস্টদের পথ সুগম করছে—ইতিহাসে দেখা যায়, মূলধারার রাজনীতি বিভক্ত হলে অতি-জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী (যেমন ১৯৩০-এর ইউরোপে ফ্যাসিজম) শূন্যতা পূরণ করে ক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশে এটি হলে সামরিক-সমর্থিত নিও-ফ্যাসিস্ট শক্তি ফিরে আসতে পারে।
যদি এই বিভেদ না মেটে, নতুন বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য ভেঙে পড়বে। সুযোগ নেবে নিও-ফ্যাসিস্ট শক্তি, যারা জাতীয়তাবাদী ছদ্মবেশে স্বৈরাচার ফিরিয়ে আনবে। সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হলে অপরাধ-দুর্নীতি বাড়বে, যেখানে ন্যায়বিচার অসম্ভব হয়ে পড়বে। শেষে গণতন্ত্রের মৃত্যু হবে, বাংলাদেশ আবার একনায়কত্বের ফাঁদে পড়বে—২০২৪-এর শহীদদের ত্যাগ ব্যর্থ হবে। এই বিভেদ মেটাতে উদারবাদী দর্শনের ভিত্তিতে সকল মতামতের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় নতুন বাংলাদেশ পুরনো অন্ধকারে ফিরে যাবে।