আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে না থাকা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিনিয়োগে মন্দা, প্রশাসনে অস্থিরতা, পরাজিত শক্তির নানা অপকৌশলসহ বিভিন্ন কারণে সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার চাপ প্রবল হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনে দেরি হলে বর্তমান সরকার বিতর্কিত হবে। সমস্যা তত বাড়বে। তাই চলতি বছরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে দলগুলো। এমনকি নির্বাচনি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করা হচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এটা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবস্থা নিতে।
এলডিপি প্রেসিডেন্ট ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের এখন মূল বিষয় হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচন কবে চাই এ নিয়ে আমরা এখনো টাইম নির্ধারণ করিনি। নির্বাচনি সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কার এবং নির্বাচন দুটো নিয়ে তারা কাজ করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলে আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে কবে ভোট চাই তা ঠিক করব।
বাংলদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন চাই। তবে সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণও চাই না।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা। দেশ তিন দিন সরকারবিহীন থাকার নজিরবিহীন ঘটনার পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরে। তার আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় দ্বাদশ সংসদ। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে অক্টোবর-নভেম্বরে মোট ১১টি কমিশন গঠন করে। প্রথম ধাপে করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন চলতি মাসে দেওয়ার কথা রয়েছে। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, দুদক, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। আর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ৩১ জানুয়ারির মধ্যে।
দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি মনে করে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে দেড় দশক কর্তৃত্ব করা বিগত সরকারের ‘দোসরদের ষড়যন্ত্র’। নির্বাচনে যত দেরি হবে, এমন সমস্যা তত বাড়বে। সংস্কারের উদ্যোগ এবং এর পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও নির্বাচন পাশাপাশি চলার কথা বললেও নির্বাচন যাতে ‘বিলম্বিত’ না হয়, সে দিকে রাজনৈতিক দলগুলো নজর রাখছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের জন্য দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা জানিয়েছেন। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর আরেক দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কথাও তিনি বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার না চাইলে চলতি বছরের শেষের দিকে, আর সংস্কার শেষ করতে দিলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সরকারের তরফে।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রথম থেকেই সংস্কারের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময় দেওয়ার কথা বলে আসছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দিক থেকে এ বছরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার চাপ বাড়ছে।
২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বলছে, তারা সংস্কারের বিপক্ষে নয়। তবে সব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখছে দলটি। বিএনপির নিজেদেরও ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে।
দলটি বলছে, ‘অতিপ্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে, সেটা যত দ্রুত করা যায়। বাকি সংস্কার বাস্তবায়ন জনগণের নির্বাচিত সংসদের সিদ্ধান্তে হবে। শুধু বিএনপি নয়, বিএনপির সমমনা দলগুলোও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।
বিএনপির মিত্র সংগঠন ১২-দলীয় জোটপ্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারকে সংস্কার এবং নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করে জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।
আরেক মিত্রদল জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকার এখন কোনো কিছুই সামাল দিতে পারছে না। সরকারের জনপ্রিয়তা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।