
‘আমি তাদের মুরগি খাওয়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারাই বলেছে যে খাসি খাওয়াতে হবে।’- বক্তব্যটি রাজশাহী মহানগরের ভূমি ব্যবসায়ী সাজ্জাদ আলীর। যাদের খাসির মাংস খাওয়াতে চেয়েছিলেন তারা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মোল্লাপাড়া এলাকার পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের সদস্য। সাজ্জাদের দাবি, পাহাড়িয়ারা যে জমিতে বসতভিটা তৈরি করেছে সেটির বর্তমান মালিক তিনি।
গণমাধ্যমে সাজ্জাদের এমন বক্তব্য শুনে শুরুতে মনে হয়েছিল কোনো উৎসবের আয়োজন হতে চলেছে। কিন্তু পরে জানা গেল বিষয়টি এতটা সরল নয়। এই খাসি খাওয়াতে চাওয়ার বিষয়টি কৌশলে পাহাড়িয়া নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলোকে উচ্ছেদের উপলক্ষ্য। যে আয়োজন হওয়ার কথা ছিল আজ শুক্রবার।
বাংলাদেশে পাহাড়িয়াদের মতো নৃগোষ্ঠীদের উচ্ছেদ করতে চাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বরং এটি নৃগোষ্ঠীর জমির অধিকার, ঐতিহাসিক অবিচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি উদাহরণ। পাহাড়িয়াদের দাবি, তারা গত ৫৩ বছর ধরে ওই জমিতে বসবাস করছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, হঠাৎ কেন ব্যক্তি উদ্যোগে তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা, খাসির ভোজই বা কেন দিতে চাওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা এই জমি আসলে কার?
পাহাড়িয়ারা এলো যেভাবে
রাজশাহী নগরীতে পাহাড়িয়ারা যে এলাকায় (মোল্লাপাড়া) বসবাস করে সেটি স্থানীয়দের কাছে ‘আদিবাসীপাড়া’ নামে পরিচিত। মোল্লাপাড়া ছাড়াও বাংলাদেশে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের বসবাস আছে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে। তাদের ভাষা মালতো বা পাহাড়িয়া। ঐতিহ্যগতভাবে তারা কৃষি, দিনমজুরি, ছোট ব্যবসা ও হস্তশিল্পের কাজ করে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক পাহাড়িয়া পরিবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে তারা দেখে, জমি দখল হয়ে গেছে বা নথিপত্র হারিয়ে গেছে। ১৯৭১-এর পর ছয়টি পাহাড়িয়া পরিবার রাজশাহীর মোল্লাপাড়ায় এক হিন্দু ব্যক্তির মালিকানাধীন ১৬ কাঠা জমিতে আশ্রয় নেয়। মালিকের মৃত্যুর পর জমিটি খালি পড়ে থাকে। এরপর পরিবারগুলো সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি পরিবার বেড়ে ১৬টিতে দাঁড়িয়েছে। এই জমিতে তারা ঘরবাড়ি, শৌচাগার ও নলকূপ বসিয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনও এখানে কিছু অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়েছে, যা তাদের দীর্ঘকালীন বসবাসের প্রমাণ।
জমি আসলে কার
পাহাড়িয়াদের বসবাসের জায়গায় জমির পরিমাণ ১৬ কাঠা। মহানগরী এলাকা বিবেচনায় যেটির মূল্য এখন কয়েক কোটি টাকা। অধিকারকর্মীদের ভাষ্য বর্তমান দাম ১০ কোটির কম নয়।
সাজ্জাদ আলীর দাবি তিনি জমিটি ১৯৯৪-৯৫ সালে কিনেছেন। এর সপক্ষে তিনি পবা থানার ভূমি অফিসের একটি নথি দেখিয়েছেন। পবা ভূমি অফিসের আরএস খতিয়ান নম্বর ৪০৫ অনুযায়ী, জমিটির খারিজকারী সাজ্জাদ আলী। আর মালিক বোয়ালিয়া থানার কাজিহাটার গাজিয়া রজকিনি এবং ময়মনসিংহের কোতোয়ালীর মনিতারা রজকিনি। তাদের দুজনের অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ আছে যথাক্রমে ইন্দ্রনাথ রজক ও ত্রিপল রজকের নাম। সেখানে জমির পরিমাণ উল্লেখ আছে, শূন্য দশমিক ৩৭৯৪ একর।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের বরেন্দ্র অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত অতিদরিদ্র ভূমিহীন নারী, পুরুষ এবং নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কাজ করে সিসিবিভিও নামের একটি সংগঠন। এর সমন্বয়কারী আরিফ ইথার বলছেন, সাজ্জাদ আলীর এই নথিতে পুরো জমির হিসাব নেই। তা ছাড়া, ভূমি অফিসকে বিভ্রান্ত করেও এমন খারিজ বের করা যায়।
পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদের বিষয়টি সামনে এলে জমির প্রকৃত মালিক খোঁজার চেষ্টা শুরু করে আরিফের সংগঠন। শুক্রবার তিনি সমকালকে বলেন, ভূমি অফিসের নথি ঘেঁটে এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, জমিটির মালিক ইন্দ্র ধোপা নামে এক ব্যক্তি। তিনি নিঃসন্তান। সুতরাং সাজ্জাদ আলী ওয়ারিশদের কাছে থেকে জমি খারিজের যে দাবি করেছেন সেটি আর টিকছে না।
আরিফ ইথান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর জায়গাটি বাথান ছিল। তখন এটি পরিচিত ছিল ধোপার বাথান নামে। পাহাড়িয়ারা ভারত থেকে ফিরে আসার পর তাদের সেখানে থাকতে দেন ইন্দ্র ধোপা। জমির মালিকানার বিষয়ে নিশ্চিত হতে ইন্দ্র ধোপার কোনো স্বজন আছেন কি না সেটি খোঁজা হচ্ছে।
আইনি দিক
আইনি দিক থেকে এই উচ্ছেদ প্রশ্নবিদ্ধ। দ্য লয়ার অ্যান্ড জুরিস্টস ডটকম নামের ওয়েবসাইটে ‘স্বত্বদখলীয় অধিকার’ আইনের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বত্বদখলীয় আইন অনুযায়ী, অন্য কারও মালিকানাধীন কিন্তু খালি পড়ে থাকা জমি বা সম্পত্তি নির্দিষ্ট আইনি সময়কাল ধরে প্রকৃত মালিক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি অব্যাহতভাবে ব্যবহার করলে, সেই ব্যক্তির জমি বা সম্পত্তির মালিকানা দাবি করার অধিকার জন্ম নেয়। এক্ষেত্রে প্রকৃত মালিককে কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হয় না। যারা এইভাবে কোনো সম্পত্তি দখল করে বসবাস করে, তাদের বলা হয় ‘স্কোয়াটার’।
এক্ষেত্রে জমিটির মালিকানা দাবি করা সাজ্জাদ আলীর দলিল আলস নাকি নকল সেটির তদন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আইন কম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালা, ১৯০০’ থাকলেও সমতলের নৃগোষ্ঠীদের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। যদিও নৃগোষ্ঠীদের অধিকার নিয়ে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আদিবাসী জনগণ ও ব্যক্তিরা অন্যান্য সকল জনগণ ও ব্যক্তির সমান ও স্বাধীন। তারা যেকোনো ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকার অধিকার রাখে। বিশেষ করে তাদের আদিবাসী উৎস বা পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে।’
উচ্ছেদ চেষ্টা, ভোজের আয়োজন
পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদের যিনি উদ্যোক্তা সেই সাজ্জাদ আলী রাজশাহীর হড়গ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা ও ভূমি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তাঁর দাবি ১৯৯৪ সালে ১৬ কাঠা জমি তিনি কিনে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর দলিলের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুই বছর আগে তিনি প্রথম পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদের চেষ্টা করেন। কিন্তু তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম সাজ্জাদের দলিলকে ‘ভুয়া’ উল্লেখ করে উচ্ছেদ বন্ধ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে সাজ্জাদ আবার চাপ বাড়ান। তিনি পরিবারগুলোকে প্রথমে তিন মাস সময় দেন জায়গা ছাড়ার জন্য, কিন্তু পরে তা ১০ দিনে কমিয়ে দেন।
উচ্ছেদের আগে তিনি একটি অদ্ভুত পরিকল্পনা করেন। সেটি হলো খাসি জবাই করে ভোজের আয়োজন। সাজ্জাদের ভাষায়, পরিবারগুলোই খাসি খাওয়াতে বলেছে। তাছাড়া এটি ‘বিদায়ের সুন্দর ব্যবস্থা’। কিন্তু পরিবারগুলোর দাবি, এটি চাপ প্রয়োগের অংশ। সাজ্জাদ পুনর্বাসনের জন্য ৩০ থেকে ৩১ লাখ টাকা (প্রতি মূল পরিবারে ৬ লাখ) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পাশাপাশি হুমকি দেন, প্রতিবাদ করলে কোনো টাকা দেবেন না বা জোর করে তুলে দেবেন।
ভয়ে এরই মধ্যে তিনটি পরিবার (রুবেল বিশ্বাস, শান্ত বিশ্বাস এবং অন্য একটি) বসতভিটা ছেড়ে চলে গেছে। বাকি ১৩টি পরিবারের সদস্যরা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অনিশ্চয়তায় ভুগেছেন। একটি পরিবারের প্রবীণ সদস্য ফুলমণি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘চার যুগেরও বেশি সময়ের হাসি-কান্নার জন্মভিটা ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায় না। আমরা কোথায় যাব?’
সবশেষ যা জানা গেল
পাহাড়িয়াদের মতো সম্প্রদায়ের জন্য জমি তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে তাদের জীবিকা ভূমিনির্ভর। তাই তাদের বসতভিটা ছেড়ে চলে যাওয়াটা শুধু ঘরবাড়িহীন হওয়া নয়, বরং তাদের জীবিকার শেকড় উপড়ে ফেলার মতো।
পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদ চেষ্টার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার এলাকাটিতে যান কাশিয়াডাঙ্গা থানার ওসি আজিজুল বারী। সেখানে সাজ্জাদ আলীর উপস্থিতিতে শুক্রবারের ভোজ আয়োজন ও উচ্ছেদ বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি সাজ্জাদের দলিলটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসকের দপ্তর। আপাতত ১৩টি পরিবারকে মোল্লাপাড়া এলাকায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের ওসি আজিজুল বারী বলেছেন, আমরা সবাই মিলে যেটা সুষ্ঠু সমাধান হয়, সেটা করব। যেটাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না, সেটা করব। আপাতত এখানকার বাসিন্দারা এভাবেই থাকবেন। জমির কাগজপত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে আরিফ ইথান বলছেন, থাকতে দেওয়া হলেও নিরাপত্তা প্রয়োজন। দেশের অন্যান্য এলাকায় নৃগোষ্ঠীদের উচ্ছেদের আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রাতের বেলা হামলা হয়েছে। এবার এমনটা যাতে না ঘটে সে জন্য কাশিয়াডাঙ্গা থানা পুলিশকে বলা হয়েছে। পুলিশ এ নিয়ে লিখিত আবেদন দিতে বলেছে।