
“শস্য ভান্ডার” খ্যাত দিনাজপুরের পল্লীতে সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চায় এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অনুকুল রায় নামের এক কিশোর তার ছোট আকারের রিমোট কন্ট্রোল বিমান তৈরি করে গ্রামবাসীকে চমকে দিয়েছেন।
গত ৩১ আগষ্ট রবিবার তার গ্রামের মাঠে পরীক্ষামূলক ভাবে তার বিমানটির উড়ানোর দৃশ্য দেখতে ভিড় করেছেন স্থানীয় বিভিন্ন বয়ষী সাধারণ মানুষজন ও স্কুলের সহপাঠীরা। বিমানটি ছোট হলেও কার্যকর। এটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রাথমিকভাবে তাই কম দূরত্বে উড়ানো হয়েছে। অনুকুলের এই উদ্যোগ শুধু তার নিজের সৃজনশীলতার প্রকাশ নয়, বরং পুরো গ্রামের শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। তার বিমানটিকে দেখে এলাকার শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রবীণরাও মুগ্ধ বনেছেন। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন“এটা কি সত্যিই আমাদের গ্রামের ছেলেটার বানানো?”
জানা যায়, দিনাজপুর জেলার খানাসামা উপজেলার ভেরভেরি ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিন মজুর পরিবারে জন্ম নেয় অনুকূল। বাবা রানজিৎ রায় পেশায় কাঠমিস্ত্রি। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তার আগ্রহ। আর্থিক সীমাবদ্ধতা তার স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও বাবার উৎসাহ ও সহযোগিতায় উদ্ভাবনী কাজ চালিয়ে যায়। শৈশবের খেলার সাথীরা যথন মাঠে মত্ত খেলাধুলায়, অনুকুল তখন আকাশ ও প্রযুক্তি নিয়ে সৃষ্টি কাজে থাকত বিভোর।
সম্প্রতি তিনি আঙ্গারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেছেন। টেকনোলজি নিয়ে শেখার মানসিকতায় প্রায় দুই বছর ধরে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই বিমান তৈরী করেছেন। তার বিমানটি আকারে ছোট। তবে নকশা, কাঠামো এবং প্রযুক্তি তার নিজস্ব গবেষণার ফসল। কাঠামোতে ব্যবহার করেছেন হালকা মজবুত অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিল। ইঞ্জিন ব্যাবহার করেছেন পুরনো মোটরসাইকেলের অংশ থেকে ছোট পেট্রোল ইঞ্জিন। কার্বন ফাইবার পেন্ট দিয়ে বানিয়েছেন ডানা। এছাড়াও বিমানটিতে রয়েছে রেডিও কন্ট্রোলার, লিপো ব্যাটারি, বিএলডিসি মোটর ও কার্বো মোটর, প্রপেলার ও স্পিড কন্ট্রোলার, ছোট ফ্যান, চাকাযুক্ত ল্যান্ডিং গিয়ার, প্রতিটি অংশ রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ওজন প্রায় ৬৫ কেজি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সহজেই এই বিমানকে বহন করতে পারবেন। মাত্র ৩০ হাজার টাকা ব্যায়ে কিশোর অনুকূলের তৈরি মডেল বিমান প্রযুক্তিগত দক্ষতার এক অনন্য উদাহরণে পরিণত হয়েছে।
একান্ত আলোচানায় সে জনকন্ঠ’কে জানায়, “আমি ছোটবেলা থেকেই আকাশে উড়তে চেয়েছি। ইউটিউবে ভিডিও দেখে বিমানের নকশা আঁকা শুরু করি। এক সময় ভাবলাম, কেন আমি নিজের হাতে বানাতে পারব না? এই কৌতূহল ও একাগ্রতায় দুই বছরের বিরতিহীন শ্রমে তিনি সফলতা পান। এই উদ্ভাবনী সময়ে বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও কখনও হাল ছাড়তেনা। অবশেষে তৈরীর পর বিমানটির নাম দেন “দ্য রয়েল স্কাই-১১০”। তিনি আরও জানান,“যন্ত্রাংশ কেনার জন্য অনেক সময় বাজারে গিয়েছি, টাকা জোগাড় করতে কষ্ট হয়েছে। প্রথমবার উড়ানোর চেষ্টা করলে বিমানটি ভেঙে পড়ে যায়। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। অনুকূল জানায় তার ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান প্রীতির কথা। পরিবারের আর্থিক সামর্থ সামান্য হলেও অনুকূলের স্বপ্নপূরণের পথে কখনো বাধা হয়নি। “অনেক সময় বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি ধার নিয়েছি। পুরনো মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশও কাজে লেগেছে। বাবাকে রাজি করানোও কঠিন ছিল, কিন্তু এখন উনি গর্বিত।
”অনুকুলের স্বপ্ন শুধু বিমান নয়, বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে কিছু করতে চাওয়াই হচ্ছে তার লক্ষ্য। ফলে আবিস্কারের পিছনে ছুটছেন অবিরত।
গ্রামবাসী জানায়, অনুকূলের এই উদ্ভাবন শুধু তার পরিবারের নয়, বরং পুরো এলাকার গর্ব। তাদের বিশ্বাস, ভবিষ্যতে অনুকূলের হাত ধরে আরও বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এলাকার সুনাম বাড়াবে।
শিক্ষকরা জানায়, ক্লাসে মনোযোগী হলেও তার আগ্রহ শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যে কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে স্কুলে তৈরি করেছিলেন একটি রোবট। যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
শিক্ষক পরাণ চন্দ্র রায় বলেন, “অনুকূলের মেধা দেখে আমরা অবাক হয়েছিলাম। গ্রামের একটি ছেলে, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়া এমন উদ্ভাবনী কাজ করতে পাবরবে। এটা ভবাববার মত বিষয়।
অনুকূলের বাবা রণজিৎ রায় বলেন, "আমার সামর্থ্য সীমিত, তবুও ছেলের স্বপ্ন পূরণে আমি সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করি। তার এই আবিষ্কারে এলাকার মানুষজনও খুবই খুশি। আশা করি, আমার ছেলে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করবে।
স্থানীয় চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম বাবুল জানান, “আমি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাবে। সাথে তাকে যথাযথ সহযোগিতা করব। যেন সে আরও কিছু তৈরী করে দেশে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কামরুজ্জামান সরকার বলেন, “অনুকূলের উদ্ভাবনী সাফল্য প্রশংসনীয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে উৎসাহ দেওয়া হবে।”
তবে পল্লীর অনুকুল রায়ের উদ্ভাবন আজ পরবর্তি প্রজন্মে কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক। এটি তরুণদের জন্য পাথেয় হবে। সাথে অনুকুলের হাত ধরে প্রযুক্তি খাতে নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারে কৃষি প্রধান বাংলাদেশ।