
রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারের ফুটপাতে ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাই করছে ১৪ বছরের কিশোর জয় রবিদাস। সামনে কয়েক জোড়া জুতা; পাশে যন্ত্রপাতি। এখানেই এক যুগ বসে কাজ করেছেন তার বাবা রূপলাল রবিদাস।
গত ৯ অগাস্ট মেয়ের বিয়ের দিন নির্ধারণ করতে আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পথে ‘চোর সন্দেহে’ মারধরে নিহত হন রূপলাল। তার সেই শূন্য আসনে এখন বসতে হয়েছে ছেলে জয়কে।
তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা জয় তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। বাবাকে হারিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণের পথ থমকে গেছে। উল্টো সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে নামতে হয়েছে বাবার ফেলে যাওয়া পেশায়।
জয় বলছিল, পরিবারের হাল ধরার লড়াইয়ে জিততে চায়। বিচার চায় তার বাবার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের। আর কাউকে যেন কাউকে ‘মব সন্ত্রাসে’ প্রাণ হারাতে না হয়, সে দাবিও তার ঠোঁটে-মুখে।
নিহত রূপলালের স্মৃতিচারণ করে তারাগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আবু হানিফ বলেন, “আমার দোকানের সামনে ১২ বছর ধরে রূপলাল জুতা সেলাইয়ের কাজ করেছেন। তিনি খুব সৎ মানুষ ছিলেন। খবরের কাগজ পড়তে ভালোবাসতেন। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার করিয়ে বড় করার স্বপ্ন দেখতেন।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হানিফ বলেন, “আজ সেই জায়গায় তার স্কুলপড়ুয়া ছেলে বসে আছে। এ দৃশ্য শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়।”
তারাগঞ্জ বাজারে নতুন চৌপথী বাসস্ট্যান্ড থেকে অগ্রণী ব্যাংক মোড়ের মধ্যবর্তী স্থান জুতাপট্টির সামনের রাস্তার পাশে বসে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জুতা সেলাই ও রং পালিস করে জয়। তব বাবার দক্ষতা এখনও হাতে ওঠেনি এ কিশোরের।
ওই বাজেরের আরেক দোকানদার আবু মিয়া বলছিলেন, “রূপলাল দাসের মত এত ভালো লোক হয় না। তিনি নিরীহ মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন বাজারে মুচির কাজ করেছেন। কিন্তু কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া-বিবাদে লাগেনি।”
রূপলালকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে আবু মিয়ার। বলেন, “সহজ-সরল এই মানুষটাকে পিটিয়ে হত্যা করে তার পরিবারকে পথে বসাল। স্কুল যাওয়া বাদ দিয়ে জয় এখন জুতা সেলাই করছে। দুঃখ লাগছে ওকে দেখে ছোট মানুষ কি করবে।”
রূপলালের বড় মেয়ে নুপুর রবিদাসের কাছে বাবা শুধু সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিউ ছিলে না; ছিলেন হৃদয়ের কাছের মানুষ। তাকে হারানোর কষ্ট সইতে রা পারার স্পষ্ট ছাপ দেখা গেল নুপুরের চোখে-মুখে। সেদিন তার বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়েই প্রাণ হারাতে হয়েছে বাবকে।
সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল জানতে চাইলে ক্ষীণ কণ্ঠে নুপুর বলেন, “আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা। এ জন্য প্রদীপ দাদা আমাদের বাড়িতে আসছিলেন। রাস্তা না চেনায় বাবা কাজীরহাট থেকে দাদাকে আনতে যায়। সেখান থেকে দাদার ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে বটতলায় লোকজন তাদের আটক করে মারধর করে। খবর পেয়ে রাতে বুড়িরহাট গিয়ে বাবা-দাদার রক্তাক্ত দেহ শনাক্ত করি।”
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখের কোণে জল আসে নুপুরের। বলেন, “এভাবে মানুষ মারা অমানবিক। বাবাই ছিলেন আমাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তাকে হারিয়ে আমাদের পুরো পরিবার আজ দিশেহারা।”
ছোট ভাই জয়কে এখন সংসার চালানোর জন্য জুতো সেলাইয়ের কাজ ধরতে হয়েছে- এটাও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার মনে।
নুপুর বলেন, “বাবা বেঁচে থাকলে ছোট ভাইকে স্কুল ছেড়ে ফুটপাতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হতো না। ছোট ভাইয়ের রোজগারে সংসার চলছে-এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ। যদি উপায় থাকতো তাহলে জয়কে কাজ করতে যেতে দিতাম না।
“যে ছেলের এখন স্কুলে থাকার কথা, সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাসে করার কথা-সেই ছেলের কাঁধে আজ সংসার চালানোর দায়িত্ব।”
নুপুরে সঙ্গে কথা শেষ হতেই হাহাকারে ভরা কণ্ঠে ভেসে আসল-“কিছু মানুষ আমাদের সুখ-শান্তি চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছে।” বলছিলেন রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী রবিদাস।
ভারতী বলছিলেন, “সংসারে আর কোনো পুরুষ নেই। জয়ই এখন একমাত্র ভরসা। কতটুকু আয় করতে পারবে জানি না। তবে সেই আয় দিয়েই আমাদের কোনোভাবে বাঁচতে হবে। ছেলেটাকে স্কুলে পাঠাতে না পেরে বুক ফেটে যাচ্ছে।”
“ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার স্বপ্ন ছিল আমার স্বামীর। ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে সংসারের হাল ধরবে, দূর হবে অভাব-অনটন। সত্যিকারের আলোয় ভালো থাকার হাসিতে বাঁচবে পুরো পরিবার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে তার মৃত্যুতে। সেই শূন্য আসনই এখন ছেলে জয়ের ঠিকানা।”
জয় যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেই তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল হক বলেন, “আমাদের ছাত্র জয়কে রাস্তায় জুতা সেলাই করতে দেখে মন ভেঙে গেছে। বাবাকে হারানোর কারণেই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এ দৃশ্য সমাজের জন্য এক নিদারুণ শিক্ষা।”
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ই্উএনও) রুবেল রানা বলেন, “জয়ের বিষয়ে আমরা প্রশাসন থেকে সব সাহায্য সহযোগিতা করব। আমি তাকে বলেছি স্কুলে যেতে; পড়াশুনা করতে।”
গত ৯ অগাস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে ভাগ্নি জামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে নিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাদের পথরোধ করে চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এক পর্যায়ে সন্দেহভাজনরা প্রদীপ লালের কালো ব্যাগ তল্লাশি করে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং কিছু ওষুধ পান।
বোতলের ঢাকনা খোলার পর দুর্গন্ধে বুড়িরহাট এলাকার মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে উত্তেজিত হয়ে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে নিয়ে যান।
এরপরই সেখানে লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে তাদের দুজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরে সেখান থেকে প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। পরদিন রোরবার ভোরে প্রদীপেরও মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পরদিন ১০ অগাস্ট রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০-৭০০ জনকে অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এখন পর্যন্ত এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
যদিও এই মামলার এজাহার ঘিরে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। রূপলালের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ ইচ্ছে করেই ‘মনগড়া তথ্য’ যুক্ত করে মামলা সাজিয়েছে, যাতে প্রকৃত দায়ীদের আড়াল করা যায়।
এদিকে ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি ও ভুক্তভোগীদের উদ্ধার না করার বিষয়টি এজাহারে না থাকায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ও সন্দেহ দানা বাঁধছে।
জয় বলে, “আমার বাবাকে যখন মারে তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল। কিন্তু সে কথা মামলায় লেখা নাই। পুলিশ লিখছে, তারা নাকি হাসপাতালে দেখছে।
“এই মামলাটা তারা নিজে নিজে থানায় মনমতো লিখে আমার মায়ের সাইন নিছে। বাবার গায়ে দোষ দিয়া মামলা লিখছে। পুলিশ এখন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।”
রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী অভিযোগ করে বলেন, “মামলা সম্পর্কে কিছু জানি না। কাগজে কী লেখা আছে, তাও জানি না। যখন মারা গেছে তারপর থানা থেকে লোক আসছে। কাগজ নিয়া আমার কাছ থেকে সাইন নিয়া গেছে।
“কিন্তু কাগজে কী লেখা আছে, সেটা জানি না। পরে শুনি আমি বাদী, আমি মামলা করছি।”