Image description

সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কলেজের একটিমাত্র হায়েস গাড়ি রক্ষানাবেক্ষণ, গারিচালকের বেতন এবং তেল খরচ বাবদ এক বছরে প্রায় ৬২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়; মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের আগমন এবং খাবার বাবদ দেড় লাখ টাকা বিল করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম। কলেজের তহবিল থেকে এমন অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের খবর কলেজ জুড়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)  তদন্ত শুরু করেছে।

অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির তদন্ত দলের প্রধান সংস্থাটির কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক প্রফেসর বি. এম. আব্দুল হান্নান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ। বিষয়গুলো তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তাধীন কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমরা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করছি। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মাউশি ও কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর আমিনুল ইসলাম। এর পরই বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মানী বণ্টনে অনিয়ম শুরু করেন। শুধু গত এক বছরে অন্তত চারটি পাবলিক পরীক্ষা—উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স পার্ট-১, অনার্স পার্ট-২ এবং ডিগ্রি—এবং তিনটি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা—উচ্চ মাধ্যমিক হাফ-ইয়ারলি, অনার্স পার্ট-২ ও মাস্টার্সসহ তিনটি ব্যবহারিক পরীক্ষার অর্থ বণ্টনে মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা উপেক্ষা করে ২০ লাখ টাকার অতিরিক্ত আদায় করেছেন। পরবর্তীতে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে এ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

পাবলিক কিংবা অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা নয়; কলেজের টেস্ট পরীক্ষার ক্ষেত্রেও অর্থ নয়ছয় করেছেন তিনি। টেস্ট পরীক্ষা পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ সম্মানী পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি ৭০-৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন।

সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য কোনো বাস না থাকলেও তিনি শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে ২৫০ টাকা করে আদায় করছেন। এতে বছরে প্রায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। পরিবহনের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ অধ্যক্ষের ব্যবহারের জন্য হায়েস গাড়ির পেছনে ব্যয় করা হয় বলে জানা গেছে। নিজের ব্যক্তিগত কাজে এ গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। গাড়ি মেরামত এবং তেল খরচ বাবদ বছরে ৬২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। যদিও একটি হায়েস গাড়ির পেছনে এক বছরে এতটাকা ব্যয় হওয়া অসম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কলেজের উন্নয়ন খাতেও একই ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে চার বছরে একবার উন্নয়ন ফি দিতে হয়। এ ফি ১০০ টাকা নেওয়ার বিধান থাকলেও অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম প্রতিবছর একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে উন্নয়ন ফি’র জন্য ২০০ টাকা করে তুলছেন। যার ফলে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ৭০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। শুধু এ খাত থেকেই বছরে ২০ লাখ টাকার বেশি বাড়তি অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কিংবা অনুমোদনের নামে অর্থ আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলামিক স্টাডিজ, মার্কেটিং ও ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে কয়েক লাখ টাকা নেওয়ার পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নাম ব্যবহার করে দেড় লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় আইসিটি খাতে ৫০ টাকা করে নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে অধ্যক্ষ এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তিনি ১০০ টাকা করে আদায় করেন। কলেজে ২৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর কাছে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থের পরিমান ১৫ লাখ টাকার বেশি।

কলেজে চিকিৎসা খাতে শিক্ষার্থীপ্রতি ২০ টাকা করে নেওয়ার নিময় থাকলেও অধ্যক্ষ নিজের ক্ষমতা বলে ২৫ টাকা করে আদায় করেন। প্রতিবছর এ খাত থেকে আড়াই লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় হলেও কার্যত কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই। নামমাত্র একটি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে, যেখানে স্যালাইন খাওয়ানো ও প্রেসার মাপার বাইরে আর কোনো সেবা মেলে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ছাত্র সংসদ খাতেও মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বছরে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা আদায় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় প্রতি বছর একবার বিবিধ খাতে ১০০ টাকা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও ভর্তির সময় এবং ফরম পূরণের সময় পৃথকভাবে এ অর্থ আদায় করেন তিনি। অভ্যন্তরীণ খাতের অনিয়মও চোখে পড়ার মতো। কলেজ সূত্র জানায়, প্রতি বছর ভর্তি ও ফরম পূরণের সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ১০০ টাকা করে তোলা হচ্ছে। এ খাত থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা বাড়তি আদায় হয়েছে। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলামের অনিয়মের শেষ নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ২৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ টাকা পরীক্ষার জন্য এবং ১৫০ টাকা কেন্দ্রের জন্য। দুটি মিলিয়ে সাড়ে ১৩ লাখ টাকার বেশি পায় কলেজ। এ অর্থ থেকে কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক এবং কমিটির ১৪ জনকে দুই লাখ ৭০ হাজার এবং আরও আড়াই লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট টাকা অধ্যক্ষ নিজেই নিয়েছেন। যদিও এভাবে টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। এ টাকাগুলো ভুয়া বিল-ভাউচার করে সমন্বয় করা হয়।’

ওই শিক্ষক আরও বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা ফি-র সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ টাকা যোগ করে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করেছেন। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ২০২৫ সালের পরীক্ষায় কেন্দ্র ফি থেকে অবৈধভাবে নেওয়া ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা পরে ভাউচারে খাসির মাংস কেনা দেখিয়ে সমন্বয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি।’

নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রফেসর আমিনুল ইসলাম। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছু শিক্ষক এবং কয়েকজন বখাটে শিক্ষার্থী তার সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য দুদক এবং মাউশিতে অভিযোগ দিয়েছেন। কলেজের একটি হায়েস গাড়ি রয়েছে। এ গাড়ি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসার কাজে ব্যবহার করা হয়। গাড়ির মেইনটেন্স খরচ রয়েছে। ফলে অর্থ খরচ হবেই। একটি হায়েস গাড়ির জন্য বছরে এতটাকা কীভাবে ব্যয় হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসপেকশন দলকে চা-নাস্তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, কয়েক লাখ টাকা নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। খাবার-দাবারের জন্য কিছু টাকা খরচ করা হয়েছিল। তবেও সেটিও খুব বেশি না। মাউশির ডিজির জন্য টাকা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। তার আগমন উপলক্ষে দেড় লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ করায় আমার সম্মানহানী হয়েছে।

ভুয়া বিল ভাউচার এবং আগের অধ্যক্ষের আমলে কেনা আসবাবপত্র পুনরায় ক্রয় করে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর অনেকেই জাল করে। জাল স্বাক্ষর দিয়ে কেউ ভুয়া ভাউচার তৈরি করে থাকতে পারে। পুরোনো আসবাবপত্র নতুন করে কেনার প্রমাণ রয়েছে জানালে তিনি সেগুলো নিয়ে তার অফিসে যেতে বলেন। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে গিয়ে দেখা করে তথ্য নেওয়ার কথা জানান।