Image description

ফ্যাসিস্টের দোসর’ হিসাবে চিহ্নিত আমলা, বিচারপতি, সেনা কর্মকর্তা এবং এদের অনেকের স্ত্রীর পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল মিলেছে। সম্প্রতি তাদের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেওয়া হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন জুলাই হত্যা মামলার আসামি। কয়েকজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত অভিযোগের তদন্ত চলছে। এছাড়া একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতির অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এনওসি পাওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্টদের বেশ কয়েকজন দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। ইতোমধ্যে এদের কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টে সরকার পতনের পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। এছাড়া বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিচারপতি ও ভাইস চ্যান্সেলরের (ভিসি) পাসপোর্ট নবায়নে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বিশেষ করে কূটনৈতিক মর্যাদার লাল পাসপোর্ট রূপান্তরে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ করে আগের সেই কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার।

এ বিষয়ে জানার জন্য সোমবার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রশ্ন লিখে পাঠাতে বলেন। পরে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তিনি এর কোনো উত্তর দেননি। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পাসপোর্ট পেলেও যারা অভিযুক্ত তাদের পক্ষে সহজে দেশত্যাগ করা সম্ভব হবে না। কারণ ইমিগ্রেশনেই তাদের আটকানো হবে। তবে অনেকেই তাদের লাল পাসপোর্ট নিয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে সংশ্লিষ্টদের পাসপোর্টের বিষয়ে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, ১৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি চিঠিতে মোট ৩৯ জনের পাসপোর্টের বিষয়ে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব নীলিমা আফরোজ স্বাক্ষরিত চিঠির সঙ্গে দুটি তালিকাও সংযুত্ত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘বর্ণিতদের অনুকূলে বিধি মোতাবেক প্রাধিকার অনুযায়ী পাসপোর্ট প্রদানে নির্দেশক্রমে অনাপত্তি জ্ঞাপন করা হলো।’ যে ৩৯ জনের নামে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয় তারা হলেন-সাবেক বিচারপতি কাজী রেজাউল হক, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি আতাউর রহমান খান ও তার স্ত্রী রেহানা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামাল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) নকিব আহমদ ও তার স্ত্রী সুজানা তারান্নুম চৌধুরী, পিএসসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক মুবিনা খন্দকার ও তার স্বামী মাসুদুর রহমান, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, অধ্যাপক কাউসার আহমেদ ও তার স্ত্রী অধ্যাপক শামিমা সুলতানা, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মোহাম্মদ দিদার-উল-আলম, পিরোজপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি কাজী সাইফুদ্দিন ও তার স্ত্রী রুকসানা ইয়াসমিন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মোহাম্মাদ আব্দুর রশিদ ও তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা সুলতানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি গোলাম সাব্বির সাত্তার ও তার স্ত্রী তানজিনা ইয়াসমিন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরীর স্ত্রী পারভিন সুলতানা।

 

তালিকায় আরও আছেন-ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী সায়লা পারভিন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নাহিদ রশিদ, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী ও তার স্ত্রী মাসুমা আকতার, প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সেলিম রেজা ও তার স্ত্রী আনজুমান আরা বেগম, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শাহদাত হোসেন ও তার স্ত্রী শাহিনা পারভিন, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ও তার স্ত্রী মুনমুন চক্রবর্তী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সাবেক সচিব ওয়াহিদ ইসলাম খান ও তার স্ত্রী রুনা নাহিদ আকতার, নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়াম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের স্ত্রী লায়লা জেসমিন, দুদকের সাবেক কমিশনার জোহরুল হক ও তার স্ত্রী মাসুদা বেগম এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সিনিয়র সচিবের স্ত্রী সান্ত্বনা রানী দত্ত।

তালিকার এক নম্বরে আছে হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের নাম। সরকার পতনের পর স্বৈরাচারের ঘনিষ্ঠ যে ১২ বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন রেজাউল হক তাদের অন্যতম। তিনি তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বদলে সাধারণ পাসপোর্ট পেতে ৬ জানুয়ারি আগারগাঁও অফিসে আবেদন জমা দেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে যথারীতি তার আবেদন আটকে যায়। এরপর থেকে তিনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার করে আসছিলেন।

পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্রের ভিত্তিতে রেজাউল হকের পাসপোর্ট নবায়ন করে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে আরও তিন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, সালমা মাসুদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান ও তার স্ত্রী রেহানা বেগমের পাসপোর্টের বিষয়েও সরকারের অনাপত্তি পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, বিচারপতি রেজাউল হকের পাসপোর্টের বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তরফেও অনেকটা অস্পষ্ট প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এনএসআইর যুগ্ম পরিচালক শেখ মোহাম্মদ জিয়াউল কাদির স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রেজাউল হক রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ মতাদর্শী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় রায়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ রয়েছে। এমতাবস্থায় তার পাসপোর্ট ইস্যুর বিষয়ে যথাসমীচীন কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।’

বিচারপতি রেজাউল হকের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য সোমবার তার পাসপোর্ট আবেদনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করা হয়। ফোনে তার ছেলে ওমর ফেরদৌস বলেন, বাবার অবস্থান সম্পর্কে গণমাধ্যমে তিনি কোনো কিছু বলবেন না। রেজাউল হক অসুস্থ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগী হিসাবে হয়তো মানবিক দিক বিবেচনায় বাবাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি তালিকার ৫ নম্বরে আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) নকিব আহমদ ও তার স্ত্রী সুজানা তারান্নুম চৌধুরীর নাম। আগস্টে সরকার পতনের পর তিনিও সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৬ জানুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে ক্যান্টনমেন্ট পাসপোর্ট অফিসে তার আবেদন জমা হয়। কিন্তু সরকারের ছাড়পত্র না থাকায় তার আবেদন আটকে যায়। তবে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র জারির মাত্র ২ দিনের মধ্যে নতুন পাসপোর্ট হাতে পান নকিব।

সূত্র জানায়, হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক পিএসসি (সরকারি কর্মকমিশন) সদস্য মনোনীত হন। প্রাধিকার অনুযায়ী তারাও কূটনৈতিক মর্যাদার লাল পাসপোর্ট পান। সরকার পতনের পর কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। ফলে পিএসসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক মুবিনা খন্দকার, দেলোয়ার হোসেন এবং কাউসার আহমেদ তাদের লাল পাসপোর্ট নিয়ে বেকায়দায় পড়েন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন তারা। সম্প্রতি তাদের নামেও অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক মুবিনা খন্দকার বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, তার পাসপোর্টের বিষয়ে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তথ্য উপাত্ত নেওয়া হয়েছে। এরপর তাকে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। পাসপোর্ট পেলে বিদেশে চলে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মুবিনা খন্দকার বলেন, ‘আমি আমার কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে শিক্ষকতা করছি। এখানেই থাকব। অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা আমার নেই।’

অনাপত্তিপত্র পাওয়া আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অন্যতম হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামাল। জুলাই অভ্যুত্থানকালে সরাসরি ছাত্র হত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া তিনি আরও একাধিক জুলাই হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। সম্প্রতি শেখ হাসিনার সঙ্গে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর কথোপকথন প্রকাশের পর আত্মগোপনে চলে যান মাকসুদ কামাল।

পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র দেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের পাসপোর্ট পেতে আর কোনো বাধা নেই। আবেদন করলেই তারা পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। তবে হঠাৎ কেন তাদের বিষয়ে সরকার নমনীয় হয়েছে সে ব্যাখ্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে পারবে।