Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী হয়েছেন আবদুল কাদের। খোলামেলা কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যোবায়ের আহমদ
  
সমকাল: ডাকসু নির্বাচন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন? 

আবদুল কাদের: আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা আমাদের ভালো চোখে দেখছে। আমাদের সুবিধা হলো, আমরা নতুন কোনো মুখ নই বা নতুন করে জাতীয় পরিমণ্ডল থেকে এই নির্বাচনে হাজির হচ্ছি না। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান কিংবা তার আগেও আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছি। তাই শিক্ষার্থীরা আমাদের ভালোভাবে নিচ্ছে। 

সমকাল: আপনাদের দলের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এটা সমস্যা তৈরি করছে কিনা? 

আবদুল কাদের: একাধিক প্রার্থী থাকা সাংগঠনিকভাবে ঠিক হয়নি। তবে আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। গণঅভ্যুত্থানের পরে যেহেতু এ সংগঠন গঠিত হয়েছে, সবার একটি কমিটমেন্ট আছে। তারা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে; ক্যাম্পাসের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করছে; ক্যাম্পাসে কাজ করতে চায়। এ জায়গায় ডাকসু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু পদ তো সীমিত। তাই আমরা কাউকে আটকে রাখিনি। যাদেরকে প্যানেলে যোগ্য মনে করেছি, তাদেরকে প্যানেলে মনোনীত করেছি। আর যাদেরকে মনে করেছি, তাদেরকে স্বাধীন করে দিয়েছি। তারা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সমকাল: নির্বাচনী প্রচারে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা? 

আবদুল কাদের: প্রথমত, মনে হচ্ছে মিডিয়া একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কৃত্রিমভাবে হাইপ (উচ্ছ্বাস) তৈরি করে দিচ্ছে এবং অন্য গোষ্ঠীকে আন্ডারমাইন করছে। এটি জটিলতা তৈরি করছে। দ্বিতীয়ত, প্রশাসন আমাদের যৌক্তিক প্রস্তাবনাগুলো আমলে নিচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, তারা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

আমরা বারবার পরীক্ষাগুলো পিছিয়ে দেওয়ার কথা বললেও তারা আমলে নেয়নি। আবার হঠাৎ এক সপ্তাহ ছুটি ঘোষণা করেছে, যাতে সুইং ভোটাররা বাড়ি চলে যায়। ফলে এক ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মধ্যে চলতে হচ্ছে। 

বড় একটি সমস্যা হলো অনলাইনে চরিত্রহনন। কেউ ভালো কাজ করলেই ফেসবুকে তাদের চরিত্র হনন করা হয়। নারী শিক্ষার্থীদের কাছে আমার প্রচারণার একটি ছবি ডিউ ইনসাইডার নামে পেজ থেকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ওই নারী স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে পারেন।
 
সমকাল: অনলাইনে চরিত্রহনন বা বুলিংয়ের প্রভাব অফলাইনে কেমন পড়ছে? 

আবদুল কাদের: এটি একজন প্রার্থীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে; ট্রমাটাইজ করে দেয়। শুধু প্রার্থী নয়; তার বাবা-মা এবং পুরো ইতিহাস টেনে এনে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়। কোনো যুক্তিনির্ভর সমালোচনা করা হয় না। আমার মনে হয়, অফলাইনে মারামারির চেয়ে অনলাইনে বুলিং অনেক বেশি মারাত্মক। এর প্রভাবও বেশি। এটি মানসিক অবস্থাকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দেয়। যদি দলগুলোর সদিচ্ছা থাকে, নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন এটিকে গুরুত্ব দিত, তাহলে হয়তো এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেত। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলে।

সমকাল: নির্বাচিত হলে আপনারা প্রথম কোন বিষয় নিয়ে কাজ করবেন?

আবদুল কাদের: নির্বাচিত হলে আমাদের প্রথম কাজ হবে ছাত্র রাজনীতির একটি কাঠামো দাঁড় করানো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতি এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী এবং সক্রিয় ছাত্র সংগঠন– এই তিন অংশীজনকে নিয়ে বসে ছাত্র রাজনীতির ধরন ও কাঠামো কেমন হবে; হলে রাজনীতি থাকবে কিনা, সে বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণ করতে চাই। আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি রূপরেখা এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি সামাজিক চুক্তি (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট) করতে চাই। এই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও অনলাইন-অফলাইনে হয়রানি বন্ধ করা। আমরা সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠন করে আইনগতভাবে এটি মোকাবিলা করতে চাই। তবে শুধু আইন দিয়ে এটি সম্ভব নয়। নারী সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

সমকাল: নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। আপনারা নারীদের কাছে কেমন সমস্যা পেয়েছেন? 

আবদুল কাদের: ক্যাম্পাসে অনেক নারী বিভাগের শিক্ষক কর্তৃক হয়রানি বা অনৈতিক প্রস্তাবের শিকার হয়, কিন্তু কোনো বিচার হয় না। নিপীড়নবিরোধী সেল পুরো অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। আমরা এ ধরনের ঘটনার সুরাহা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই, যাতে নারীরা নির্ভয়ে ক্যাম্পাসে আসতে পারে এবং তাদের পরিবারও আশ্বস্ত হয়। আর অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে ঢুকতে না পারা বা অসুস্থ মায়ের সেবা-শুশ্রূষার জন্য আসতে না পারার মতো অদ্ভুত নিয়মগুলো পরিবর্তন করতে হবে।

সমকাল:   প্রশাসনিক সংস্কার কিংবা আবাসন সংকটের বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনাদের ভাবনা কী? 

আবদুল কাদের: প্রশাসনিক হয়রানি কমাতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিজিটালাইজ করতে চাই। একটি ওয়ানস্টপ সলিউশন অ্যাপের মাধ্যমে ভর্তি থেকে শুরু করে সনদ উত্তোলনের সকল কাজ সম্পন্ন করা গেলে প্রশাসনিক ভোগান্তি অনেক কমে আসবে। আবাসন সংকট নিরসনে আমরা প্রস্তাব করছি, একজন শিক্ষার্থী যেদিন ভর্তি হবে, সেদিনই তার সিট অ্যালটমেন্ট নিশ্চিত করতে হবে। যদি সিট দিতে না পারা যায়, তাহলে তাকে ফ্রি আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। 

সমকাল: একাডেমিক সংস্কারের ব্যাপারে আপনারা কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন? 

আবদুল কাদের: আমরা প্রস্তাব করছি, প্রতিটি কোর্সের কারিকুলাম ওয়েবসাইটে আপলোড এবং ক্লাসের ভিডিও আপলোড করা হবে। এতে শিক্ষক নিজে সচেতন হবেন এবং তাদের সহকর্মী, দেশ-বিদেশেও তাদের পাঠদান সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে। ফলে তাকে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতেই হবে। আর শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এবং ৭৩-এর অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে প্রভোস্ট, চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনিক নিয়োগগুলোর নিয়োগবিধি তৈরি করতে চাই। এতে দলীয় প্রভাব কমে আসবে। 

সমকাল: শিক্ষার্থীদের প্রধান উদ্বেগের জায়গাগুলো কী? শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশার কথা কী বলছে?

আবদুল কাদের: শিক্ষার্থীরা আর্থিক মুক্তির ব্যাপারটি বলছে। সে জন্য আমরা ক্যাম্পাসের ভেতরে পার্ট টাইম কাজের ব্যবস্থা এবং অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যাপারটি বলেছি। অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করার কথাও আমরা ভাবছি, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠান সহজেই করতে পারে।

সমকাল: ডাকসু নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা কী? 

আবদুল কাদের: ডাকসুকে আরও কার্যকর করতে নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি জরুরি। ডাকসুর ক্ষমতাবিধিরও সংস্কার করা জরুরি। বর্তমানে ভিসির হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, যা পরিবর্তন করে ডাকসুকে অথরিটি প্রদান করতে হবে।

সমকাল: শিক্ষার্থীরা কেন আপনাকে নির্বাচিত করবে বলে মনে করেন?

আবদুল কাদের: আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীরা একটি আস্থা এবং অভয়ের জায়গা চায়। তারা ৯০-এর দশকের মতো গণরুম-গেস্টরুম নির্যাতন ফিরে আসুক– এটা চায় না। আবার যে গোষ্ঠী অতীতে অত্যাচারে জড়িত ছিল বা শুধু সংকটের সময় নিজের স্বার্থ দেখেছে, তারা এখন নতুন কথা বলছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা জানে, তারা পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা নতুন করে কোনো অঙ্গীকার নিয়ে আসিনি বা হঠাৎ ক্যাম্পাসে ফিরে আসিনি। জাতীয় রাজনীতি বা নিজের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমরা শিক্ষার্থীদের পাশেই রয়েছি। হামলার শিকার হয়েছি, জেল খেটেছি, মামলা মোকাবিলা করেছি। তবুও আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে গেছি। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা সেই মানুষটিকে বিবেচনা করবে, যাকে তারা সংকটে পাশে পেয়েছে। তারা কোনো জাতীয় নেতাকে চায় না। তারা চায় তাদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি উঠে আসুক। আমি তাদেরই একজন; তাদের পাশে রয়েছি– এই আস্থা ও অভয়ের জায়গা তৈরি করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছি এবং দুঃসময়ে তাদের পাশে ছিলাম। এই বিষয়টিই শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বিবেচনা করবে বলে আমার বিশ্বাস।

সমকাল: অপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল কাদের: সমকালের পাঠকদেরও ধন্যবাদ।