
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী ও বালু নদ থেকে গত এক যুগে ১০৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এসব লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ দুই নদ-নদীতে রয়েছে ১৭টি বিপজ্জনক স্থান। এসব স্থান সাধারণত নীরব থাকে।
তাই অপরাধীরা লাশ ফেলে যাওয়ার নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নেয়। থানা পুলিশ, নৌ পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুই নদ-নদীর বিপজ্জনক স্থানগুলোতে নৌ পুলিশের টহল যেমন নেই, তেমনি নেই সিসি ক্যামেরাসহ পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা।
পুলিশ বলছে, অন্য কোনো স্থানে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদী ও বালু নদের রূপগঞ্জ অংশের নির্জন স্থানে লাশ ফেলে যাচ্ছে খুনিরা।
বিশেষ করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলার ঘটনা বেশি।
থানা পুলিশ জানায়, কিছু লাশের ক্ষেত্রে শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ হত্যা মামলা করছে। হত্যার আলামত পাওয়া না গেলে অপমৃত্যুর মামলা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বেশির ভাগ পরিচয়হীন লাশের ঠিকানা হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে।
এসব হত্যা বা অপমৃত্যুর মামলার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির রহস্য পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পারলেও বহু মামলা বছরের পর বছর তদন্তের বেড়াজালে আটকে আছে।
কেন শীতলক্ষ্যা-বালুকে বেছে নেওয়া : অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার খুব কাছে রূপগঞ্জ। সেখানে যাতায়াতও সহজ। তাই খুনিরা ঢাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে আসে। শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলার আরেকটি বিশেষ কারণ হলো, লাশ এক জায়গায় থাকে না।
স্রোতের টানে অন্য জায়গায় ভেসে যায়। অনেক সময় লাশ মেঘনার মোহনায় চলে যায়। বালু নদে শীতলক্ষ্যার মতো স্রোত নেই বলে সেখানে লাশ কম ফেলা হয়।
লাশ উদ্ধারের উল্লেখযোগ্য ঘটনা : রূপগঞ্জ থানা, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা, হাসপাতাল, নৌ পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত এক যুগে শীতলক্ষ্যা নদীর সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে রূপগঞ্জ অংশে ৯২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১৫টি লাশ বালু নদ থেকে উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ ও নৌ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ চলতি বছরের ২৪ আগস্ট কাঁচপুর নৌ পুলিশ সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল থেকে মাথাবিহীন একটি লাশ উদ্ধার করে। ২৪ এপ্রিল চনপাড়া পুনর্বাসনের সামনে থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী জয় সরকারের লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৯ এপ্রিল দাউদপুর ক্যাপিটাল মেরিনা জেটির সামনে থেকে জোবায়ের হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৯ জানুয়ারি সাইলো ঘাট থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০২৪ সালের ১৬ নভেম্বর নোয়াপাড়া ঘাট থেকে কলসবাঁধা অবস্থায় ওমর আলী নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হয়। ২০২১ সালের ২০ মে কাঞ্চন নবারুণ জুট মিলের সামনে থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। উল্লেখযোগ্য লাশ উদ্ধারের ঘটনার মধ্যে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি বড়ালু ঘাট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র পারভেজ আহম্মেদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
বালু নদ থেকে ২০২৪ সালে ধীত্পুর এলাকা থেকে অর্ধগলিত যুবকের লাশ উদ্ধার করে রাজাখালী নৌ পুলিশ। ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর স্কুলছাত্র ওসমান গনির লাশ কায়েতপাড়া বাজারের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়।
বিপজ্জনক ১৭ স্থান : অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমে বালু নদ ঘেঁষা রাজধানী ঢাকা, পূর্বে আড়াইহাজার ও সোনারগাঁও, উত্তরে গাজীপুর আর দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ-সোনারগাঁও। এসব এলাকার সঙ্গে রূপগঞ্জের যোগাযোগব্যবস্থাও খুব সহজ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রূপগঞ্জে যাতায়াতের সড়ক রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে চিটাগাং রোড-কাঁচপুর হয়ে রূপগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী-স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে রূপগঞ্জ, মেরাদিয়া-আমুলিয়া হয়ে রূপগঞ্জ, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী হয়ে রূপগঞ্জ, বাড্ডা-মাদানীনগর-বেরাইদ হয়ে রূপগঞ্জ, ডুমনী-পাতিরা হয়ে রূপগঞ্জ, কুড়িল বিশ্বরোড হয়ে রূপগঞ্জ এবং ডেমরা-চনপাড়া হয়ে রূপগঞ্জ সড়ক। এসব সড়কের মধ্যে চিটাগাং রোড ও স্টাফ কোয়ার্টার সড়ক হরদম ব্যস্ত থাকলেও অন্য সড়কগুলো সন্ধ্যার পর একেবারে নীরব হয়ে যায়। এসব সড়কে পুলিশের কোনো ফাঁড়ি বা চৌকি নেই। এতে অপরাধ ঘটানোর একটা সুযোগ তৈরি হয়।
বালু নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে। এ দুই নদ-নদীতে পুলিশের নৌ টহলের ব্যবস্থা নেই।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য : অনুসন্ধানে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যার চনপাড়া পুনর্বাসন এলাকার চর লাশ ফেলার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এ ছাড়া দাউদপুরের বেশ কয়েকটি ইটভাটা এলাকা, ভোলাব এলাকার কয়েকটি ইটভাটা এলাকা, খৈসাইর এলাকা নিরাপদ স্পট। সবচেয়ে নিরাপদ স্পট বালু নদের নড়াই ইটভাটা, ফকিরখালীর ফাঁকা জায়গা, চানখালীর ফাঁকা জায়গা, কামশাইর এলাকার ফাঁকা জায়গা, দক্ষিণপাড়ার ফাঁকা জায়গা এবং বাউলের বাজার এলাকা নিরাপদ স্পট।
কামশাইর এলাকার সাত্তার মিয়া বলেন, ‘রাত অইলে বালু নদের আশপাশের এলাকা পুরাই নীরব থাকে। লাশ ফালাইয়া গেলে কেউ দিশা পাইবো না। ’
তারাব এলাকার আতাউর রহমান বলেন, ‘মানুষ খুন করে এখানে ফেলে যাওয়া সহজ। নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া সেতু থেকে লাশ ফেলে গাড়ি নিয়ে দ্রুত তারা চলে যেতে পারে। তাই সেতুগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানো দরকার। কোনো সেতুতে সিসি কামেরা নেই। ’
ডোম জাকির হোসেন জাগুর ২৫ বছর ধরে লাশ বহন করছেন। তিনি বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা আর বালু গাঙ থেইক্যা বেশির ভাগই পচা-গলা লাশ উদ্ধার করি। এইগুলান চিনন যায় না। শীতলক্ষ্যা থেইক্যা বছরে ১২ থেকে ১৩টা লাশ উদ্ধার করি। বালুতে কম। তয় ১২ বছরে দেড় শর বেশি লাশ শীতলক্ষ্যা আর বালু গাঙ থেইক্যা উদ্ধার করছি। ’
প্রশাসনের ভাষ্য : রূপগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জের অনেক এলাকা দুর্গম হওয়ায় এবং অপরাধ সংঘটনের স্থান হিসেবে নিরাপদ মনে করায় দুর্বৃত্তরা এসব জায়গায় লাশ ফেলে রেখে যায়।
ইছাপুরা নৌ পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পরিতোষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমাদের লোকবল ও জলযান পর্যাপ্ত নেই। ’ সহকারী পুলিশ সুপার (গ সার্কেল) মেহেদী ইসলাম বলেন, নদীকেন্দ্রিক এই অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পর্যাপ্ত লাইটিং এবং সিসিটিভি ভিডিও ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। পর্যাপ্ত জলযান ও জনবলের বিষয়ে এরই মধ্যে জানানো হয়েছে। রূপগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, শীতলক্ষ্যা ও বালু ঢাকার পাশে হওয়ায় অপরাধীরা এটা নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, শুধু বালু বা শীতলক্ষ্যা নয়, ঢাকার আশপাশের নদ-নদীতে আগের চেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যাচ্ছে। হত্যাকারীরা অন্য জায়গায় হত্যা করে নদীতে এসে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। কারণ এসব নদীতে ফেললে লাশ শনাক্ত করা যায় না বা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। সুরতহাল রিপোট পাওয়া যায় না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।