Image description
জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য ইস্যু

আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় এবার নেপথ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দেনদরবার করছে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ পর্যন্ত কয়েকটি দলের সঙ্গে একাধিক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের আয়োজন করে কমিশন। দল টু দল এবং দলের লিডারদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান ফর্মুলায়ও এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এজেন্ডা হিসেবে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি মৌলিক বিষয় রাখা হয়। কিন্তু নেপথ্যের এসব বৈঠকে ঐকমত্যের পরিবর্তে বিভেদ বেড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলেন, এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘সেইফ হাউস’ নামের স্থানগুলোতে। সাধারণত কমিশন দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের এলডি হল কিংবা রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠক করে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোর জন্য এ দুটি স্থান বাদ দেওয়া হচ্ছে।

কমিশনসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। কিন্তু দূরত্ব কমছে না। বরং শেষ মুহূর্তে এসে ফারাক আরও বাড়ছে। আগে ছিল প্রস্তাব, এখন শর্তে পরিণত হয়েছে। প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নানান বিষয়ে যোজন যোজন দূরত্ব। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ কমিয়ে একটা ঐক্যের জায়গায় পৌঁছাতে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো এখন পর্যন্ত যথেষ্ট সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আশা করি তারা এটা অব্যাহত রাখবে।’

একটা ইস্যুতে এসে আলোচনা থমকে আছে বলে জানান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তাঁরা বলেন, ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন কোন প্রক্রিয়ায় হবে-এ নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপি চায় পরবর্তী সংসদ ঐকমত্য হওয়া মৌলিক ইস্যুগুলো বাস্তবায়ন করবে। অন্যদিকে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি চায় নির্বাচনের আগেই। অর্থাৎ সংস্কার বাস্তবায়নের পরে নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে। গত সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় বৈঠকের পরিকল্পনা ছিল ঐকমত্য কমিশনের। কিন্তু নেপথ্যের বৈঠকগুলো ফলপ্রসূ না হওয়ায় ওই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে কটি বিকল্প উপায় পাওয়া গেছে সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করেনি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

কমিশনসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। কার্যকর উপায় গণভোট বা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের অভিপ্রায় ভিত্তি করে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করা সম্ভব, আবার ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে গণভোটের মাধ্যমেও বৈধতা দেওয়া যায়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘তিনটি প্রস্তাব একসঙ্গে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান খুঁজতে হবে। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো একটি আইনসম্মত ও বাস্তবসম্মত পথ বের করবে।’ কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে আছে যে দলগুলো আলোচনার টেবিলে বসলেই ঐকমত্যের পরিবর্তে বিভেদের নতুন নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির সাফ কথা-‘আমরা এতে নেই’। এমনকি উচ্চকক্ষেও তাদের আপত্তি। জামায়াত-এনসিপির সুর একই। তারা বলছে, পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হলে তাদের পক্ষে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়। গণভোট প্রশ্নেও ভিন্নমত স্পষ্ট। বিএনপি বলেছে, এটা সংবিধানে নেই। কমিশন তাদের পরিকল্পনায় জানিয়েছে, যেসব মৌলিক ইস্যুতে দলগুলোর কাছাকাছি মতামত রয়েছে, সেসব দলের সঙ্গে বৈঠক করবে কমিশন। উদ্দেশ্য-বিভেদ কমিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা। আবার যেসব ইস্যুতে বিভেদ বড় সেসব ইস্যু আপাতত আলোচনার টেবিলে স্থান পাবে না বলে জানানো হয়েছে। রাজনীতিবিদরা জানিয়েছেন, কমিশনের সামনে এখন মূল প্রশ্ন-কীভাবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি তৈরি হবে এবং কে সেই সনদ বাস্তবায়নের গ্যারান্টি দেবে। নির্বাচনের আগে এ প্রশ্নের সমাধান না হলে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হচ্ছে কমিশনের মেয়াদ।

তবে কমিশনসংশ্লিষ্টরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, জুলাই সনদ কার্যকর রূপ দিতে হলে মেয়াদ আবারও বাড়ানো হতে পারে। চলতি সপ্তাহে কয়েকটি ইস্যু নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে কমিশন। এরই মধ্যে রবিবার ও গতকাল অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে কমিশন। এসব বৈঠককে সংশ্লিষ্টরা পর্দার আড়ালের বৈঠক বলে চিহ্নিত করছেন। গতকাল সংসদ সচিবালয়ের এলডি হলে ১৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জুলাই সনদ ও সনদ বাস্তবায়ন এ দুটি ইস্যু রয়েছে আমাদের সামনে। কমিশন জানিয়েছে আমরা যেসব মতামত দিয়েছি, সেসব বিষয়ে কয়েক দিনের মধ্যে লিখিতভাবে জানাবে কমিশন। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব কি করব না। অন্যদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা এর আগে কমিশনকে মতামত জানিয়েছি। তারা এখন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে সুপারিশ বাস্তবায়নের পথ সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করবে বলে আমাদের জানিয়েছে।’ জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশের পটভূমিতে পাঁচটি প্রস্তাব, দ্বিতীয় অংশে ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি সিদ্ধান্ত এবং তৃতীয় অংশে রয়েছে আটটি অঙ্গীকার। আবার ঐকমত্য হওয়া ৮৪টির মধ্যে ১৪টিতে নোট অব ডিসেন্টও (ভিন্নমত) রয়েছে।