Image description

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর একটি ছিল ‘ডলার সংকট’। টানা তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ সংকট আমদানি, বিনিয়োগ, শিল্প উৎপাদন, এমনকি সাধারণ বাজারকেও অস্থির রেখেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়েছে রেকর্ড পরিমাণ নিম্নে, ব্যাংকগুলো ডলার সরবরাহে হিমশিম খেয়েছে, এলসি খোলার ক্ষেত্রে সীমাহীন জটিলতা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতেই ডলার সরবরাহে এসেছে এক নতুন মোড়। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয়ে রেকর্ড বৃদ্ধি দেখা গেছে। বৈদেশিক দায় শোধের পরও বাজারে ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি না করে উল্টো কিনছে—যা কয়েক বছর ধরেই দেখা যায়নি। তাহলে কি বলা যায়—ডলার সংকট সত্যিই কেটে গেছে?

রফতানি ও রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবাহ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য রফতানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। শুধু জুলাই মাসেই রফতানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে রেকর্ড ২৫ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় সাফল্য।

একই সময়ে প্রবাসী আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে—যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের বছরের তুলনায় এ প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশেরও বেশি। হুন্ডি কমে অফিসিয়াল চ্যানেলে অর্থ পাঠানো বেড়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে শ্রমবাজারও কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।

এই দুই খাত রফতানি ও রেমিট্যান্স—ডলারের বাজারে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিয়েছে।

এলসি খোলায় স্থবিরতা: বিনিয়োগের সংকেত

তবে বিপরীত বাস্তবতাও আছে। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা কার্যত স্থবির। গত জুনে মাত্র ৪.১৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা সাড়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনেও এলসি খোলা হয়েছিল ৫.৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এলসি খোলার নিম্নগতি মূলত নতুন বিনিয়োগ না বাড়ার প্রতিফলন। দেশের অর্থনীতির স্বাভাবিক চাহিদা মেটাতে প্রতি মাসে ৫-৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলার প্রয়োজন হয়। অথচ এখন সেই গড়ও ধরা যাচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি অর্থনীতির স্থবিরতার অঘোষিত সংকেত।

এখনও এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সতর্কতা

এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন অতিমাত্রায় সতর্ক। অতীতে আমদানির আড়ালে বিপুল অর্থপাচার, ভুয়া বিল প্রদানের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির ঘটনা ব্যাংকগুলোকে দিশেহারা করেছে।

২০১২ সালে বৈশ্বিক মন্দার সময় উচ্চ দামে পণ্য আমদানি করে অনেক ব্যবসায়ী কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলস্বরূপ খেলাপি ঋণ এক বছরে দ্বিগুণ হয়ে যায়—২২ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪২ হাজার কোটিতে। এই ধাক্কা আজও কাটেনি।

এ কারণেই এখন ব্যাংকগুলো কেবল পরীক্ষিত ও আর্থিকভাবে সক্ষম কোম্পানির এলসিই অনুমোদন করছে। শতভাগ মার্জিন নেওয়া হচ্ছে, অনেক ব্যাংক বাড়তি চার্জও বসাচ্ছে।

উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ: আছে বাড়তি খরচ ও সুদের বোঝা

অপরদিকে উদ্যোক্তারা এলসি খুলতে আগ্রহী নন। সুদহার ও ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া এর বড় কারণ। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৯ শতাংশ সুদে আমদানি অর্থায়ন করা যেতো। এখন সেই হার দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকের অতিরিক্ত চার্জ। ব্যাংকগুলো বাজার থেকে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানিকারকদের ওপর সেই বাড়তি চাপও চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমদানি খরচ বাড়ছে বহুগুণ।

মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্প খাতে ধস

সবচেয়ে বেশি ধস নেমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতে এলসি খোলা কমেছে ২৫ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৬ শতাংশের বেশি। কাঁচামাল আমদানিও কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ।

অবকাঠামো খাতেও বড় কোনও প্রকল্প অগ্রসর হচ্ছে না। ফলে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও কাঁচামালের চাহিদা নেই। বিশেষজ্ঞরা এটিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতার স্পষ্ট চিহ্ন বলে মনে করছেন।

সরবরাহ বাড়লেও চাহিদা নেই

অতীতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতো বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন উল্টো বাজার থেকে কিনছে। জুলাই মাসেই প্রায় ৫০ কোটি ২০ লাখ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “বাজারে ডলারের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা কম। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনেছে।”

শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমেছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত বহু খাতের আমদানিও কমেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। ফলে দেশের আমদানি ব্যয় অনেকটা কমে এসেছে।”

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

অর্থনীতির অন্যতম বড় অন্তরায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে।

তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আপাতত বেড়েছে বটে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা হ্রাস, ইউরোপের মন্দাভাব ও মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা—এসব চ্যালেঞ্জ সামনে অপেক্ষা করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে বিনিয়োগ বাড়ানো কঠিন হবে। ফলে আমদানি চাঙা হবে না, ডলারের চাহিদাও দীর্ঘমেয়াদে বাড়বে না।

তাহলে কি সংকট কেটেছে?

সংখ্যার হিসাব বলছে—ডলার সরবরাহ বেড়েছে, রিজার্ভ বাড়ছে, রফতানি ও রেমিট্যান্স আয় রেকর্ড করেছে। কিন্তু অর্থনীতির প্রাণ আমদানি ও বিনিয়োগ এখনও শ্লথ।

বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সতর্ক করে বলেন, “আমাদের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে এলসি খোলার প্রবণতা এভাবে কমে যাওয়া বিপজ্জনক। সরকারকে দ্রুত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে হবে। তা না হলে ডলার প্রবাহ থাকলেও অর্থনীতি চাঙা হবে না।”

সব মিলিয়ে চিত্রটা দ্বিমুখী। একদিকে রেমিট্যান্স ও রফতানির জোয়ারে বাজারে ডলার সরবরাহ পর্যাপ্ত, রিজার্ভ বাড়ছে। অপরদিকে বিনিয়োগ, আমদানি ও শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতা কাটেনি। তাই অর্থনীতিবিদদের ভাষায়—“ডলার সংকট আপাতত কেটেছে, তবে টেকসই সমাধান আসেনি।”