Image description

বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল সাউথের’ জন্য নয়া কৌশলের ঘোষণা দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সোমবার রাশিয়া ও ভারতীয় নেতাদের অংশগ্রহণে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন  বেইজিংয়ের ওই নেতা। সেখানে আধিপত্যবাদ এবং ক্ষমতার রাজনীতির সমালোচনা করে নতুন পরিকল্পনা জানিয়েছেন তিনি। সরাসরি কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শি জিনপিং। বলেছেন, ক্ষমতার রাজনীতির বিপরীতে বহুপক্ষীয় রাজনীতির অনুশীলন করতে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি কটাক্ষ করেই সম্মেলনে এ কথা বলেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। যার মাধ্যমে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তিনি।

শি উল্লেখ করেন, বিশ্ব শাসনব্যবস্থা একটি নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এসসিও’র এবারের সম্মেলনটি চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে অংশ নিয়েছে ২০টির বেশি দেশ। বক্তৃতায়  দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বাগত জানান শি। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে এই সম্মেলন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি চীন-সমর্থিত উদ্যোগে নতুন গতি এনেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ঐক্য ও সংহতির বার্তা দিতে একটি ছবিতে পুতিন ও মোদিকে হাত ধরে হাসিমুখে চীনা প্রেসিডেন্টের দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে এই তিন নেতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হাসছিলেন। তিন নেতার এমন ছবি বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। 

দ্য চায়না-গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্ট নামক একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান সম্পাদক এরিক ওলান্ডার বলেন, দৃশ্যটি সাজানো ছিল নাকি স্বতঃস্ফূর্ত, তা বলা কঠিন। তবে এটা আসলে কোনো বিষয় নয়। তিনি আরও বলেন, যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার সহযোগীরা শুল্ক আরোপ করে চীন, ভারত বা রাশিয়াকে নতজানু করতে চেয়ে থাকেন, তবে এই দৃশ্যটি অন্য কথা বলছে। সম্মেলনের পর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য পুতিনের নিজস্ব আর্মার্ড অরুস লিমুজিনে তার সঙ্গে একই গাড়িতে ভ্রমণ করেন মোদি। এক্সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লেখেন, তার (পুতিনের) সঙ্গে কথোপকথন সব সময়ই গভীর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পুতিন রুশ ভাষায় মোদিকে প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, প্রিয় বন্ধু বলে সম্বোধন করেন।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার ক্ষেত্রে চীন এবং ভারত হলো সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এই তেল কেনার জন্য ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। যদিও চীনকে এড়িয়ে গেছেন তিনি। বেইজিংয়ের সদর দপ্তর বিশিষ্ট এসসিও অঞ্চলটির বাইরে খুব বেশি পরিচিত না হলেও এটি দুই দশকেরও বেশি আগে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট হিসেবে গঠিত হয়েছিল। চীন, রাশিয়া এবং চারটি মধ্য এশিয়ার দেশ এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।  যেখানে ২০১৭ সালে যোগ দেয় ভারত।

শি জিনপিং তার গ্লোবাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা উদ্যোগ) জন্য কোনো নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা জানাননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং চীনের নেতৃত্বকে তুলে ধরতে বেইজিংয়ের এটি ধারাবাহিক নীতির সর্বশেষ কাঠামো। এর আগে, শি ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে সৃষ্ট অস্থিরতার মধ্যে আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পক্ষে জোর দেন। তিনি এই সংস্থার বিশাল বাজার এবং অর্থনৈতিক সুযোগের প্রশংসা করেন।

স্থিতিশীলতার জন্য নয়া ব্যবস্থা: ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন পুতিন। বলেছেন, এবারের সম্মেলন বহুপক্ষীয় সুযোগ পুনরুজ্জীবিত করেছে। যেখানে পারস্পরিক লেনদেনের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করা হচ্ছে। পুতিন বলেন, এর ফলে ইউরেশিয়ায় নতুন স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠনের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইউরোকেন্দ্রিক এবং ইউরো-আটলান্টিক মডেলের মতো হবে না। এটি প্রকৃত অর্থেই বিভিন্ন দেশের স্বার্থ বিবেচনা করবে। সত্যিকারের ভারসাম্যপূর্ণ হবে এবং একটি দেশকে অন্য দেশের ক্ষতি করে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ দেবে না।

এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে একটি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান শি। এর মাধ্যমে মার্কিন ডলার এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ক্ষমতাকে এড়িয়ে বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম তৈরির ওপর জোর দেন তিনি। বেইজিং এই বছর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বিনামূল্যে ২ বিলিয়ন ইউয়ান সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শি বলেন, চীন এসসিও-ভুক্ত দেশগুলোর জন্য একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহযোগিতা কেন্দ্রও তৈরি করবে। এই দেশগুলোকে চীনের চন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রেও অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

বেইজিং এই শীর্ষ সম্মেলনকে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে। গত রোববার সাত বছরে প্রথমবারের মতো চীন সফরে যান মোদি। শি এই বিষয়ে একমত হন তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং উন্নয়ন সহযোগী। তারা বাণিজ্য উন্নয়নের উপায় নিয়েও আলোচনা করেন। আলাদাভাবে শি এ সপ্তাহের বুধবার বেইজিংয়ে একটি বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে তার সঙ্গে পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জাপানের আত্মসমর্পণের ৮০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের জন্য এই কুচকাওয়াজে চীন তার সর্বশেষ সামরিক প্রযুক্তি প্রদর্শন করবে। এটি সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখানো এবং প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে করা হবে।