
সম্প্রতি ২০২০ সালে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক সাংসদ ও শিল্পপ্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন আবুল বাশার সুজন। এর আগে ছিলেন পশুর হাটের ইজারাদার।
এমপি ফারুকের আত্মীয়তার পরিচয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ফারুকের ডান হাত হন। কিছুদিন পর তানোর পৌরসভার মেয়র হওয়ারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন সুজন। সেখানে বাড়ি করেন, ভোটার হন। বাগিয়ে নেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও। উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে শুরু করে হাট নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৪ বছরে কামিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্ত।
আওয়ামী সরকার পতনের এক বছর পার হলেও ক্ষমতাধর সুজনের কিছুই হয়নি। আগের সাম্রাজ্যে এখনো রাজা তিনি। ঘুরছেন প্রকাশ্যে। হয়নি কোনো মামলাও। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বিএনপির নেতাদের ব্যাকআপে চলছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পরই সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফারুকের প্রশ্রয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন সুজন। কিছুদিনের মধ্যে রাজশাহী শহরের এই বাসিন্দা নগরের বোয়ালিয়া থানা (পশ্চিম) আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ পান। পরে হন তানোর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুল, মাদ্রাসা এবং কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। তানোর উপজেলার ৫৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০টি দাখিল ও আলিম মাদ্রাসা এবং ১৪টি কলেজে কর্মচারী ও শিক্ষক নিয়োগ দেন। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সুজন শুধু নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমেই হাতিয়েছেন প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, ২০২১ সালে পৌরসভা নির্বাচনের ছয় মাস আগে নিজেকে স্থানীয় হিসেবে পরিচিত করতে তানোর পৌর এলাকার চাপড়া মহল্লায় কোটি টাকা খরচে আলিশান বাড়ি এবং গরুর খামার তৈরি করেন সুজন। এ ছাড়া সদরের গোল্লাপাড়া বাজার, কাশিম বাজার এবং কালিগঞ্জ হাটে জমি কেনেন। এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় কয়েক কোটি টাকা। রাজশাহী শহরে আবাসিক হোটেল করেছেন। কিনেছেন জমি।
পশুর হাটের ইজারাদার সুজনের বাবা
এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশুর হাটগুলোর অন্যতম তানোর উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা নওগাঁ জেলার মান্দার উপজেলার চৌবাড়িয়া হাটটি চলতি অর্থবছরে ইজারা পেয়েছেন সুজনের বাবা আবদুস সামাদ। ভ্যাট ও আয়কর মিলে হাটটি প্রায় ১০ কোটি টাকায় ইজারা নেন তিনি।
মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আলম মিয়া বলেন, ‘চৌবাড়িয়া পশুর হাটের ইজারা প্রক্রিয়ায় মাত্র একজনই অংশ নেন। এ কারণে তাঁকেই ইজারা দেওয়া হয়। হাটের ইজারাদারের নামটি এখন মনে নেই। নথিপত্র দেখে বলতে পারব। তবে ভ্যাট ও আয়কর মিলে ১০ কোটি টাকায় হাটটি ইজারা দেওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, চৌবাড়িয়া হাট সরাসরি সুজনের বাবার নামে নেওয়া হলেও তানোর সদরের গোল্লাপাড়া ও তালন্দ হাটটিও নেওয়া হয়েছে অন্যজনের নামে। গোল্লাপাড়া হাটের ইজারাদার স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা উজ্জ্বল হোসেন হলেও সুজনই তাঁকে দিয়ে বিনিয়োগ করিয়েছেন।
উজ্জ্বলের বড় ভাই আয়ান উদ্দিনও সুজনের চৌবাড়িয়া হাট দেখাশোনা করেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে উজ্জ্বলকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। আয়ান বলেন, ‘সুজন আর তার বাপের ব্যবসা-বাণিজ্য আমরা বহু আগে থেকেই দেখি। চৌবাড়িয়া হাটে তো সে আমার পার্টনার। আমাকে তো সেগুলো দেখে রাখতেই হবে।’
বিএনপির সঙ্গে সখ্য
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কৌশলী সুজন সম্পদ বাঁচাতে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তুলেছেন। তাদের অর্থ দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করেছেন। ফলে তিনি রয়েছেন প্রকাশ্যেই। সমপ্রতি সুজনকে চৌবাড়িয়া হাটে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। রাজশাহী শহর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় কৌশলে অবস্থান করে সুজন তার ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন।
ফেসবুকে নিয়মিত ছবি দিচ্ছেন। তবে সুজনের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। মেসেঞ্জারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
আত্মগোপনে থাকা তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর তানোরে প্রায় ৫ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ১২টি মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তানোরে এ দলের সুবিধা নিয়ে যারা অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, সুজন তাদের মধ্যে শীর্ষে। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়নি। তার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অঢেল সম্পদ এখন আগলে রেখেছেন বিএনপির নেতারা।’
তানোর উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব মিজানুর রহমান মিজানের সঙ্গে যুবদল করতেন সুজনের ব্যবসায়িক অংশীদার আয়ান। পরে আয়ান তাঁর হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এখন আবার আয়ান বিএনপির ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছেন। আয়ানের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সুজন। বর্তমানে সাবেক পৌর মেয়র মিজান বহিষ্কৃত থাকলেও তিনিই স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা।
সুজনের বিষয়ে জানতে চাইলে মিজান বলেন, ‘আয়ান একসময় যুবদল করত। সে সুজনের বন্ধু। সুজনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিল। তারা সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর হয়ে আমার অনেক ক্ষতি করেছিল। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।’
সুজনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তানোর থানার ওসি আফজাল হোসেন। ‘তার নামে মামলা আছে কি না সেটা দেখে বলতে হবে’ বলে এড়িয়ে গেছেন তিনি।