Image description
এসসিএনসিএল বৈঠকে প্রস্তাব অনুমোদন অর্থ উপদেষ্টার

ব্যাংক খাত সংস্কারসহ সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়নে উচ্চসুদে (অনমনীয়) পৌনে দুই বিলিয়নের বেশি (১৮৬ কোটি) মার্কিন ডলার ঋণ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ঋণের অঙ্ক দেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা (১ ডলার সমান ১২২ টাকা)। এই ঋণের মধ্যে চীনের ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)’ থেকে প্রথমবারের মতো ঋণ নেওয়া হচ্ছে ৩২ কোটি ডলার। বিদেশ থেকে সার, জ্বালানি তেল আমদানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ব্যয় হবে এ ঋণ।

সরকারের সর্বশেষ ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি অন নন-কনসেশনাল লোন (এসসিএনসিএল)’ বৈঠকে এর অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। পাশাপাশি বৈঠকে বৈদেশিক ঋণের প্রকল্প নির্দিষ্ট মেয়াদে সমাপ্ত, দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে স্বল্প সুদে (নমনীয়) এবং অনমনীয় (উচ্চসুদে) দুই ধরনের ঋণ নেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৬ সালে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে স্বল্পসুদের ঋণ কম মিলছে। ফলে অর্থনৈতিক সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চসুদে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে ঋণসেবা ব্যয় দ্রুত বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়াধীন থাকার কারণে নমনীয় ঋণ কম মিলছে কিনা প্রশ্নের উত্তরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী যুগান্তরকে জানান, অনমনীয় এবং নমনীয় দুই ধরনের ঋণই দাতাদের কাছ থেকে মিলছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে নমনীয় ঋণ মিলছে না, এটি সঠিক নয়। তিনি আরও বলেন, অনমনীয় ঋণসংক্রান্ত সর্বশেষ বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে উচ্চসুদের ঋণগুলোই। কিছু কিছু প্রকল্পের জন্য অনমনীয় ঋণই নিতে হচ্ছে।

সূত্র জানায়, উচ্চ সুদের ১৮৬ কোটি ডলারের ঋণের মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ১৪০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কারে ব্যয় হবে ৫০ কোটি ডলার। এছাড়া সার আমদানির জন্য ৫০ কোটি ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের সরবরাহ ব্যবস্থা টেকসই করণে ২০ কোটি এবং দক্ষিণ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন ঢাকা-নর্থ করিডর রোড প্রকল্পের জন্য ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যবহার হবে। এডিবি ছাড়াও জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)’ থেকে ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ঢাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নে চীনের ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)’ থেকে নেওয়া হবে ৩২ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের বাজেট সহায়তা হিসাবে ‘অপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি)’ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১১ কোটি ২৪ লাখ ডলার।

সূত্রমতে, অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সম্প্রতি ৩৯তম অনমনীয় ঋণসংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তিনি বলেছেন, এখন সুদের হার ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং সামনের সময়ে তা আরও কমে আসবে বলে প্রক্ষেপণ রয়েছে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নিতে বলেছেন। সূত্র আরও জানায়, ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য এডিবির কাছ থেকে যে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার নেওয়া হচ্ছে এর সুদহার হলো ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। প্রথম তিন বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণটি ১২ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। বিগত সময়ে ব্যাংকের অর্থ লুটপাট, ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাত ভেঙে পড়েছে। অনেকটা ভঙ্গুর অবস্থায় চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এসব সংস্কারের জন্য একটি সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। সে প্রকল্পে ঋণের অর্থ ব্যবহার করা হবে।

এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিএডিসির মাধ্যমে চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরে সার আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে নেওয়া ৫০ কোটি ডলার ঋণের সুদহার প্রায় ৬ শতাংশ। এ ঋণ প্রসঙ্গে বৈঠকে ইআরডির সচিব বলেছেন, এটি একটি অনমনীয় ঋণ। আর ঋণদাতা আইটিএফসির সঙ্গে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্পর্ক রয়েছে। এ সংস্থা থেকে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির জন্য নিয়মিত স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়ে থাকে। সে ধারাবাহিকতায় সার আমদানির জন্য ঋণের অনুরোধ করা হয় সংস্থাটির কাছে। দীর্ঘ আলোচনার পর এ অর্থায়ন করতে আইটিএফসি সম্মত হয়েছে। এ ঋণ প্রসঙ্গে বৈঠকে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে রাসায়নিক সার আমদানির জন্য এলসি খোলার চলমান অনিশ্চয়তা দূর এবং দেশে রাসায়নিক সারের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা সহজতর হবে। যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এছাড়া জ্বালানি তেল এবং তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য বিপিসি কর্তৃক ১৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ও পেট্রোবাংলার মাধ্যমে ৬০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ঋণের সুদের হার প্রায় ৬ শতাংশ। ইআরডি থেকে জানানো হয় দাতা সংস্থার সঙ্গে এ ঋণ নিয়ে নেগোসিয়েশন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এছাড়া নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের সরবরাহ ব্যবস্থা টেকসই প্রকল্পের জন্য ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ সুদহারে। ঋণটি ২ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ পরিশোধের মেয়াদ ২৫ বছর। ঋণ প্রসঙ্গে ওই বৈঠকে বলা হয়, প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা ও জলবায়ু সহনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিতরণ গ্রিডের দক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। ২০৩০ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় ঢাকা ওয়াসার পানি রাজধানীতে সরবরাহ বর্ধিত প্রকল্পের জন্য এনডিবি থেকে নেওয়া হবে ৩২ কোটি মার্কিন ডলার। এ ঋণের সুদহার ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং পরিশোধের মেয়াদ ৩০ বছর। বৈঠকে ঋণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা শোধনাগারের পানি ৪০ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের উত্তর-পশ্চিম অংশের ৫০ দশমিক ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সরবরাহ করা হবে। এছাড়া বর্ধিত ঢাকা মহানগরীর (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির আওতায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৬টি ইউনিয়ন) পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন হবে।

এছাড়া সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (এসএএসইসি), ঢাকা নর্থ করিডর রোড প্রকল্পের জন্য এডিবি থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৫ বছর মেয়াদে পরিশোধযোগ্য ঋণের সুদহার হচ্ছে প্রায় ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।