
দরজায় কড়া নাড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন আবু সাদিক কায়েম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ডাকসু নির্বাচন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা-সম্ভাবনা, সংকট সমাধানের উপায়, আগামীর বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের দেশ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমার দেশ-এর বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার মাহির কাইয়ুম।
আমার দেশ : বিগত ডাকসুগুলোর তুলনায় এবারের ডাকসু নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য কেমন?
সাদিক কায়েম : বিগত যে কোনো ডাকসু নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচন সম্পূর্ণ আলাদা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবারের ডাকসু নির্বাচন। ২০১৯ সালে যে নির্বাচন আমরা দেখেছি তা কোনো নির্বাচন ছিল না, নির্বাচনের নামে ছিল প্রহসন। সেই নির্বাচনে প্রশাসন নিজে ভোট কারচুপিতে জড়িত ছিল। শিক্ষার্থীরা সে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। আমি নিজেও ভোট দিতে পারিনি।
জুলাই বিপ্লবের আগে আমাদের (ছাত্রশিবিরের অনুসারী) হত্যা করা জায়েজ করা হয়েছিল। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা আজাদি পেয়েছি। এই আজাদির পর যে ডাকসু অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তা শহীদদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দাবি রাখে। সারা দেশের মানুষ এবারের ডাকসুতে জুলাই শহীদদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখতে চায়। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থান এবং পরিপূর্ণ একাডেমিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী রূপ দেওয়ার দাবি রাখে এবারের ডাকসু। আমি পরিপূর্ণ একটি একাডেমিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন দেখি যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে আবাসন নিয়ে ভাবতে হবে না; শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত হওয়া লাগবে না। এ স্বপ্ন আমাকে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হতে তাড়িত করছে।
আমার দেশ : ডাকসু নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ কেমন দেখছেন?
সাদিক কায়েম : নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হবে কি না-এ নিয়ে আমরা কিছুটা শঙ্কিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান ও পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট দলকে বেশি প্রতিনিধিত্ব করছে এবং তারা একটি বিশেষ আদর্শ লালন করছে। আমরা বারবার বলছি, সব অংশীজন ও ছাত্রসংগঠনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। সব প্রার্থীর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি শিক্ষকরা তাদের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন এবং তাদের দলের প্রার্থীদের বাড়তি সুবিধা দেন- তবে তারা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন।
আমার দেশ : আপনার দৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান প্রধান সংকট কী কী?
সাদিক কায়েম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পার করেও এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি। শিক্ষকদের মধ্যে অতিমাত্রায় দলীয় রাজনীতি একাডেমিক মান নিম্নমুখী করে রেখেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অনেক গৌরব-ইতিহাস আছে কিন্তু অতি রাজনৈতিক চর্চা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক গ্রাউন্ড হারিয়েছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নতুন নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন করা, জ্ঞান বিতরণ করা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক গ্রাউন্ড হারিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে না পারার পেছনে আবাসন সংকট সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। অতি রাজনীতি চর্চা করতে গিয়ে হলে কৃত্রিম আবাসন সংকট, গণরুম, গেস্টরুম কালচার তৈরি করা হয়। বাজেট হলেও হল নির্মাণ করা হয় না। খাদ্যের অনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ সে নানা সমস্যায় ভোগে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ট্রমার সংস্কৃতি তৈরি হয় তা সে সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারে না। এ কারণে আবাসন সংকট, রাজনৈতিকভাবে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকা, লাইব্রেরি সংকট এবং গবেষণায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকাকে আমি প্রধান সংকট বলে মনে করছি।
আমার দেশ : আপনি নির্বাচিত হলে প্রধানত কোন জায়গায় কী কী পরিবর্তন আনতে চান? কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আপনি দেখতে চান?
সাদিক কায়েম : আমরা এমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখতে চাই- যেখানে প্রথমবর্ষ থেকে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে পারবে। তাকে আবাসন সংকট নিয়ে ট্রমায় থাকতে হবে না। একজন শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে যোগ্য হয়ে উঠতে পারে- এমন একটি একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় চাই। আমাদের প্রত্যাশা ‘ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন’ একটি ক্যাম্পাস।
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ আছে যারা আমাদের পরে স্বাধীনতা লাভ করেও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতে অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের অবস্থা যদি দেখি কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দেখি- তাহলে দেখতে পাব একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন করে একাডেমিকভাবে সাউন্ড হওয়া, বিনিয়োগ করা দরকার- সেটি আমরা স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে এসেও দেখতে পাইনি। এছাড়া আমাদের গবেষণা বাজেট খুবই অপ্রতুল। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে ও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে মূল বাজেটের ২০-২৮ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য এবারই সর্বোচ্চ ২ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সেফটি ও সিকিউরিটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিরাপত্তা নেই। ‘সাইবার বুলিং’, পোশাক নিয়ে তাদের কটূক্তি করা হয়। এই জায়গায় আমি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক নিরাপত্তা জোরদারে প্রশাসনকে বাধ্য করা হবে। রেজিস্ট্রার বিল্ডিং কেন্দ্রীক শিক্ষার্থীদের যে হয়রানি হয়- সেটি বন্ধ করতে কাজ করব, ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসব। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নিয়োগবাণিজ্য হয় তার বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াব। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বা কর্মচারী নিয়োগে মেধা এবং যোগ্যতাকে প্রাধান্য না দিয়ে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার কারণে এটির একাডেমিক পরিবেশ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
আমার দেশ : আপনাদের প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটকেই কেন শিক্ষার্থীরা বেছে নেবে?
সাদিক কায়েম : আমাদের প্যানেলে যারা আছেন তারা শুধু ইসলামী ছাত্রশিবির মতাদর্শের না। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যাদের কণ্ঠ শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা তুলে ধরেছে তাদের নিয়ে একটি ইনক্লুসিভ প্যানেল আমরা গঠন করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশাই আমাদের প্রত্যাশা। যারা ছাত্রশিবিরের সমালোচনা করে তারাও প্যানেলে স্থান পেয়েছে। প্যানেলের প্রতিটি সদস্যদের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আছে। আমি আশা করছি, আগামীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ করতে শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর আস্থা রাখবে।
জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী এক বছরে আমরা শহীদদের আকাঙ্ক্ষার আলোকে ছাত্ররাজনীতি বিনির্মাণ করেছি। শহীদ পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, রাষ্ট্র-সংস্কার নিয়ে আলোচনা, শহীদদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা বলা—এসব কাজও আমরা জারি রেখেছি। পাশাপাশি ইনক্লুসিভ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জ শিক্ষার্থীদের নিয়ে অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন, তাদের প্রত্যাশা ও দাবি শোনা এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে উত্থাপন করা—এসব উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। গত একটি বছরজুড়ে এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছি, তাতে আমরা অনেক বেশি আশাবাদী। শিক্ষার্থীরা আমাদের নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখছে। শিক্ষার্থীরা আমাদের মূল্যায়ন করবে বলে আমি আশাবাদী।
আমার দেশ : ভিপি হিসেবে আপনি যদি নির্বাচিত না-ও হন, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে আপনার ভূমিকা কেমন হবে?
সাদিক কায়েম : আমি বিজয়ী হই কিংবা অন্য কেউ; তবে এখানে মূলত জুলাই জিতে যাবে। কারণ, আমরা জুলাইয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করতে যেভাবে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছি আগামীতেও আমরা সবাই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাব। যদি নির্বাচিত হই তাহলে কালেক্টিভ একটা কো-অপারেশনের মাধ্যমে আমরা কাজ করতে চাই। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করতে চাই। শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রশাসনকে বাধ্য করে তা আদায় করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে আমাদের স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। ইনসাফভিত্তিক বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা লড়াই করে যাব।