Image description
 

‘জুলাই আন্দোলনের পর নারীর প্রতি সাইবার বুলিং ও স্লাট শেমিং বেড়েছে। কিছু বিষয় এমন, সত্যি নিতে পারি না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে এসব আরও বাড়বে বলে ঝুঁকি নিইনি।’
কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রাবণী জামান জ্যোতি। তাঁর আক্ষেপ, আন্দোলনে ছাত্রীরা যে অবদান রেখেছেন, এখন পর্যন্ত কোথাও তারা যথাযথ মূল্যায়ন পাননি। বাড়তি হিসেবে তারা সাইবার বুলিংসহ নানা ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এ কারণে অনেক ছাত্রী জাকসুতে আগ্রহ দেখাননি।

জ্যোতির কথা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (জাকসু) প্রার্থিতার ক্ষেত্রে স্পষ্ট। প্রায় অর্ধেক ভোটার ছাত্রী হলেও, কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫ ও ১০টি ছাত্রী হলের ১৫০ পদে প্রার্থী হয়েছেন মাত্র ২৫ শতাংশ নারী। কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপিসহ চার পদে কোনো ছাত্রী নেই। অধিকাংশ ছাত্রী হলের নির্ধারিত ১৫ পদের কোটা পূরণ হয়নি। ৫৬ পদে কোনো নারী মনোনয়ন ফরমই তোলেননি।

 
 

প্রার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবান্ধব পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে। বট আইডি দিয়ে বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ থেকে ছাত্রীদের টার্গেট করে বুলিং, স্লাট শেমিং করা হয়। পুরুষ প্রার্থীরাও রেহাই পান না। ব্যক্তিগত সম্মানহানির ভয়ে অনেক ছাত্রী ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচনে আসেননি। যেমনটি বলছিলেন প্রার্থী না হওয়া জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফাইজা মেহজাবিন, ‘উপযুক্ত নারীবান্ধব পরিবেশের অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বিভিন্ন পেজ থেকে ছাত্রীদের টার্গেট করে প্রতিনিয়ত বুলিং ও ব্যাঙ্গাত্মক আক্রমণ করা হয়। বারবার অভিযোগ দিয়েও প্রশাসনের সাড়া পাইনি।’

নির্বাচন কমিশনের তথ্যে, মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯। এর মধ্যে ছাত্র ৬ হাজার ১০২; ছাত্রী ৫ হাজার ৮১৭। মোট ভোটারের ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ ছাত্রী। নির্বাচনে ছয়টি সংরক্ষিত পদ থাকলেও, তাতে ছাত্রীদের উৎসাহ দেখা যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জেইউ আপডেট, জাবিয়ান সুশীল সমাজ, জেইউ ইনসাইডার্স, জাকসু নিউজ, জাবির সকল সংবাদ, জেইউ সার্কাজম, জেইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনসহ ১০টি পেজ ও গ্রুপ থেকে নির্বাচন ঘিরে বট অ্যাকাউন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রার্থীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’-এর এজিএস (নারী) প্রার্থী মালিহা নামলাহ বলেন, ‘তপশিলের পর থেকে কয়েকটি পেজ থেকে আমাকে বুলিং 
করা হচ্ছে। ধরেই নিয়েছি, প্রচারে নামলে বুলিং আরও বাড়বে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে স্লাট শেমিং, বুলিং, এমনকি ড্রেসআপ নিয়েও কথা বলা হচ্ছে। অনেক সময় এটি চরিত্রহনন পর্যায়ে চলে যাওয়ায় ছাত্রীরা নির্বাচন প্রশ্নে দ্বিধান্বিত।

ইতোমধ্যে অনলাইন প্রচারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ বন্ধ কিংবা নীতিমালার আওতায় আনার দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল। নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার জানান, পুলিশের সাইবার ইউনিটকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। পেজ ও গ্রুপগুলো শনাক্ত করে বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে চিঠি দেওয়া হবে।

এদিকে অনলাইন বুলিংয়ের অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের জন্য শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ-২০১৮ সংস্কারে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদকে সভাপতি করে ১২ সদস্যের কমিটি করেছে প্রশাসন। কমিটি অধ্যাদেশের ২ এর (গ) ধারায় সাইবার বুলিংকে ‘অসদাচরণ’ গণ্য করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
অধ্যাপক সোহেল আহমেদ জানান, জাকসু নির্বাচন ঘিরে অনলাইনের অপপ্রচার নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। বিটিআরসিতে লিখিত দেওয়ার পাশাপাশি বিধি অনুযায়ী চিহ্নিত দোষীকে শাস্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নেবে প্রশাসন।

ডিজিটাল মিডিয়া গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামান বলেন, জাকসু নির্বাচনে সাইবার বুলিং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমান ভোটারদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলবে। একই কারণে নারীরা জনপরিসরে আসতে পারছেন না। সামনে তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রশ্নে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।