Image description

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো বিএফআইইউ বা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়্যাল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট। এই ইউনিটের প্রধান কাজ হলো বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকানো, পাচারের তথ্য উদঘাটন, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং দেশের অভ্যন্তরে অপরাধীদের আর্থিক লেনদেনগুলো নজরে রাখা। সেই হিসেবে এটিকে ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ ইউনিট হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী এই ইউনিটটির প্রধান পদে নিয়োগ দেয়ার আগে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে যথোপযুক্তভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়ে থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর বড় আশা-ভরসার এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এমন এক কর্মকর্তাকে বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যিনি অতীতে আওয়ামী আমলে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচারে ছিলেন অন্যতম সহযোগী এবং একজন চরিত্রহীন কর্মকর্তা ও শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবেও যার পরিচিতি রয়েছে। তারপরও আলোচিত এই শাহীনুল ইসলামকে বিএফআইইউ’র প্রধান পদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তবে তিনি সেই নিয়োগ পরীক্ষায় অত্যন্ত খারাপভাবে ফেল করেন। ফলে সবদিক থেকে অযোগ্য এই কর্মকর্তার নিয়োগ পাওয়ার কোনোই সুযোগ ছিল না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগের প্রস্তাবে তাঁর নামও ছিল না। তারপরও অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর এই সংস্থার প্রধান পদে তাকেই পছন্দ করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। 

নিয়োগ লাভের পর দেখা গেলো, একের পর এক তিনি অর্থ পাচারকারী মাফিয়াচক্রের স্বার্থ রক্ষা, ব্ল্যাক মেইলিং. চাঁদাবাজি, আর্থিক দুর্নীতি প্রভৃতি নানা রকমের অনিয়ম-অপকর্ম করেই চলেছেন। ব্যাংকগুলো এবং ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদাবাজির সুবিধার্থে বিএফআইইউ প্রধান শাহীনুল প্রায় এক ডজন ‘ভাগিনা’ও তৈরি করেছেন এই অল্প সময়ে। ব্যাংকের এমডি বা কোনো ব্যবসায়ীকে ফোন করে বলে দিচ্ছেন, আমার ভাগিনা ‘ওমুক’ যাবে। সে কী বলে শুনেন। কখনো কখনো কোনো টাকার অংকও উল্লেখ করে দিতেন।

গত ৯ জানুয়ারি বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগ পান শাহীনুল। এই কয়েক মাসে তিনি এরকমের চাঁদাবাজিতে ব্যাংক পাড়াকে অতীষ্ঠ করে তুলেছেন। শুধু তাই নয়, গোপনে বিকাশ-এর আতিথেয়তায় ঢাকার বাইরে প্রমোদ ভ্রমণে গেছেন- যা নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত চলছিল। যদিও ব্র্যাক এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এই বিকাশ-এর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারে জড়িত থাকার অনেক অভিযোগ রয়েছে। এর চেয়েও অবাক করার বিষয় হলো, আদালতের আদেশে ফ্রিজ হওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে ভাগবাটোয়ারার মতো কাণ্ডও ঘটিয়েছেন তিনি। সবশেষে, শাহীনুলের এমন একটা জাজ্জ্বল ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যার সঙ্গে তুলনা করা চলে একমাত্র ‘নীল ছবি’র। শাহীনুল প্রথমে এটাকে তার ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভিডিওটি নিয়ে ব্যাপক হই চই’র মধ্য দিয়ে শাহীনুলকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তদন্ত কমিটিও গঠন করেন গভর্নর। কিন্তু এসবকে উপেক্ষা করেই শাহীনুল অফিসে আসেন। গভর্নর তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নয় বলেও দাবি করেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, তাকে পরে রাতের বেলায় পুলিশ ব্যারিকেডে বাসায় পৌঁছে দিতেও বেগ পেতে হয়। এরপর থেকে অবশ্য তিনি আর প্রকাশ্যে নেই। ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি আনঅফিসিয়ালি প্রতিবেদন দাখিল করেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। 

সূত্র জানায়, শাহীনুল ইসলাম এক পর্যায়ে ওই ভিডিওটি ফেইক, এআই দিয়ে তৈরি করা বলে দাবি করলেও তদন্তে ভিডিওটির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। সিআইডির নিজস্ব ল্যাবে ভিডিওটি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এতে ভিডিও অরিজিনাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি অফিসিয়ালি মন্ত্রণালয়ে দাখিল করার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

উপদেষ্টা ও গভর্নরের ইচ্ছের বাইরে বিএফআইইউ প্রধান পদে যেভাবে নিয়োগ পেলেন শাহীনুল
গুম, খুনের পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় অপকর্মটি ছিল বিদেশে অর্থপাচার। লাগামহীন অর্থপাচারের মাধ্যমে পুরো দেশটাকেই শেখ হাসিনা ফতুর করে দিয়ে গেছেন। তাই ক্ষমতাগ্রহণের শুরু থেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ইতিমধ্যে এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পাচারকৃত একটি টাকাও বিদেশে থেকে উদ্ধার করে আনা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ প্রধান পদে এ এফ এম শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ এবং চেয়ারে বসার পর তার উল্টোমুখী কার্যক্রম। গত জানুয়ারিতে তাকে যখন এই পদে বসানো হয় মূলতঃ তখনই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। শাহীনুলকে নিয়োগের পর পরই “অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে” মর্মে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে। বাস্তবে এখন হয়েছেও তাই। 

আদতে আওয়ামী লীগ আমলে শাহীনুল ইসলাম নিজেই অর্থপাচার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন বলে প্রমাণাদি রয়েছে খোদ সরকারের হাতেই। এরপরও বিএফআইইউ’র প্রধান পদের নিয়োগ পরীক্ষার তাকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেলো, বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ফেল করেছেন। শুধু ফেল-ই নয়, এতোটা খারাপ করেছেন যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেয়া নিয়োগ পরীক্ষর মাঝপথে তার পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল। কারণ, তিনি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিলেন না। নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী প্রথম তিনজনের নাম উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে। এই তিনজন ছিলেন এ কে এম এহসান, রফিকুল ইসলাম এবং মামুন হোসেন। কিন্তু তারমধ্যেই বাধ সাধেন সরকারের আইন বিষয়ক অন্য একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা। তিনি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে বায়না ধরেন অর্থপাচার সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা এ এফ এম শাহীনুল ইসলামকে বিএফআইইউ’র প্রধান পদে নিয়োগের জন্য। এ নিয়ে অনেক চাপাচাপি হয়। তাতেও রাজি হননি অর্থ উপদেষ্টা। পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই সরাসরি নির্দেশ আসে শাহীনুলকে এই পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য। এবং সেই অনুযায়ীই প্রজ্ঞাপন জারি হয়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর নেপথ্যে কাজ করেছেন সাবেক কুখ্যাত গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং ব্যবসায়ী এস আলম। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব সাইফুল্লাহ পান্না এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক এক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। মূলতঃ এরা দু’জনই উপস্থিত থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়ে বিএফআইইউ’র প্রধান পদে শাহীনুল ইসলামের নিয়োগ কনফার্ম করেন। সাইফুল্লাহ পান্না এবং আব্দুর রউফ তালুকদার উভয়ের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত সাইফুল্লাহ পান্না অর্থ মন্ত্রণালয়েই রউফ তালুকদারের সঙ্গে ছিলেন। রউফ তালুকদারই তাকে যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিতে সহায়তা করেছেন। পরবর্তীতে এই সাইফুল্লাহ পান্না ভূমি আপিল বোর্ডের সদস্য পদে থাকাকালে সকাল-বিকেল খালেদা জিয়া সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ ভাষায় কটুক্তি করতেন বলে তাঁর সহকর্মীরা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। অন্যদিকে জুনিয়র হলেও নাজমা মোবারেক অর্থ মন্ত্রণালয়ে বরাবরই আব্দুর রউফ তালুকদারের বান্ধবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তার কাছ থেকে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। 

গোপনে বিকাশের প্রমোদ ভবনে গিয়ে ধরা 
বিকাশ বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় মোবাইল আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস) সংস্থা। এটি মূলত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন, বিল পরিশোধ, কেনাকাটা এবং অন্যান্য আর্থিক পরিষেবা সরবরাহ করে। ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিচালিত হয়। এই বিকাশ-এর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে অনেক আগে থেকে। বিকাশ যেহেতু ব্র্যাক এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বরাবরই অত্যন্ত প্রভাবশালী তাই এর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নানাভাবে এসব অভিযোগকে ধামাচাপা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশে অর্থপাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়গুলো তদন্ত করা এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অভিযোগ রয়েছে যে, এই বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারাই বরাবর বিকাশ- কে মানি লন্ডারিংয়ে প্রশ্রয় এমনকি সহযোগিতাও দিয়ে এসেছে। আর সেই অভিযোগটির হাতেনাতে প্রমাণ দিলেন স্বয়ং বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারা নিজেরাই অতি গোপনে বিকাশ’র আতিথেয়তায় প্রমোদ ভ্রমণে গিয়ে। 

কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণে গেলেও এবং তাৎক্ষণিকভাবে ধরা না পড়লেও পরবর্তীতে ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট ১১ জন কর্মকর্তা ওই প্রমোদ ভ্রমণে যান। এরা সবাই বিএফআইইউ’র। বিএফআইইউ’র প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম এতে নেতৃত্ব দেন। দু’দিনের এ প্রমোদ ভ্রমণটি হয় গত মে মাসে সিলেটে। ভ্রমণের যাতায়াতসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন ছাড়াও বিকাশ কর্তৃপক্ষ ১১ জন বিএফআইইউ কর্মকর্তার প্রত্যেককে নগদ ডলার-এর আকর্ষণীয় উপহারও দিয়েছেন। ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে শাহীনুলকে তলব করা হয়। তিনি এর জবাব দিতে পারেননি। পরবর্তীতে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তেও এটা প্রমাণিত হয়েছে। 

আদালতের অবরুদ্ধ ২৮ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ভাগবাটোয়ারা 
খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদেও। এই পদ দুটো ব্যবহার করে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে পরিবহন খাতে ব্যাপক নৈরাজ্য চালিয়েছেন। চাঁদাসহ নানা রকমের অনিয়ম-অপকর্মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ আমলে। বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ১২০ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়েছিল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে। আদালতের আদেশেই এই টাকা ফ্রিজ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্য থেকে গোপনে ২৮ কোটি টাকা অবৈধভাবে আনফ্রিজ করেন বিএফআইইউ’র প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে টাকাগুলো ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। তারমধ্যে শাহীনুল পেয়েছেন ৫ কোটি, জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শীর্ষনিউজ