
একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এক বছর ধরে চলমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নির্বাচন ঘোষণার পর প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি প্রস্তুত। তার মতে, হাতে এখনো সময় রয়েছে। একটি নিরাপদ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন করতে কোনো অসুবিধা হবে না।
পুলিশ সদরদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পুলিশ সদস্যদের সক্ষম করে তোলা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, ভোটকেন্দ্র ও এর আশপাশের ঝুঁকি বিবেচনা করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন, ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা এবং ইতিপূর্বে লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্রসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার।
এছাড়া, বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় যানবাহনের জোগান এবং নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পুলিশের বদলি হবে লটারির মাধ্যমে। এর বাইরে নির্বাচনকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব বা ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে ‘জাতীয় তথ্য কেন্দ্র’ গঠনের উদ্যোগও গ্রহণ করেছে পুলিশ। যেসব সাধারণ পুলিশ সদস্য এখনো আতঙ্কিত বা দুর্বল মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের জন্য নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ছাড়াও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
পাশাপাশি নির্বাচনকালে প্রিসাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হবে ‘অস্ত্রসহ আনসার’ সদস্য। সেনাবাহিনীও থাকবে এবং সীমান্তে দায়িত্ব পালন করবে বিজিবি। নৌ-সীমান্ত অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করবে কোস্ট গার্ড।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পুলিশ সদস্যদের সক্ষম করে তোলা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, ভোটকেন্দ্র ও এর আশপাশের ঝুঁকি বিবেচনা করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন, ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা এবং ইতিপূর্বে লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্রসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার

এ বিষয়ে রাজনৈতিক, নির্বাচন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিগত সরকারের আমলে নির্বাচনী ব্যবস্থার কবর রচনা করা হয়েছে। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে এবং দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ওপরই নির্ভর করতে হবে সরকারকে। তারা বলছেন, ছয় মাস পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। নির্বাচনে দলনিরপেক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে তাদের আশা, এবার মাঠে শুধু পুলিশ নয়, সশস্ত্র বাহিনীও থাকছে। এবার সেনাবাহিনীর ভূমিকা রিজার্ভ নয়, বরং নিয়মিত। ফলে সবাই মিলে সহযোগিতা করলে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, “নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন চ্যালেঞ্জ তো বটেই। তবে, আমার মনে হয় না এটা খুব কঠিন হবে। কারণ, ৫ আগস্টের পরবর্তী অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। অনেক পরিবর্তন এসেছে। আর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার আলোকেই তো পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনে পুলিশের দায়িত্বও নির্ধারিত। সুতরাং খুব যে বেগ পেতে হতে পারে, সেই উদ্বেগটা এখন নেই। আর সেনাবাহিনী এবার নিয়মিত ফোর্স হিসেবেই থাকবে।”
নির্বাচনী দায়িত্ব—
৩১ আগস্ট থেকে শুরু হচ্ছে পুলিশের প্রশিক্ষণ: আইজিপি
নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে পুলিশ কতটা সক্ষম? জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমরা প্রশিক্ষণ শুরু করতে যাচ্ছি। এই প্রশিক্ষণই আমাদের সক্ষম করে তুলবে। আমরা ঢাকায় আগামী ৩১ আগস্ট থেকে প্রশিক্ষণ শুরু করছি। আর ঢাকার বাইরে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করব। এটা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ, যা পুলিশকে সক্ষম করে তুলবে।”
পুলিশের অনেকে জানেনই না কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়
আইজিপি বলেন, “গত তিনটি নির্বাচনে ওইভাবে পুলিশকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। তাই পুলিশকে ব্যস্ত হতে হয়নি এবং সেরকম প্রশিক্ষণও ছিল না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশে অনেক লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই জানেন না আসলে নির্বাচনে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়, ফেয়ার ইলেকশনের জন্য দায়িত্বটা কী! এগুলো আমরা প্রশিক্ষণে বুঝিয়ে দেব, প্র্যাকটিক্যালি ডেমো দেখাব, আমরা ভিডিও দেখাব এবং ক্লাস নেব।”

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ
জেলাপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা যথাসম্ভব ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই এক লাখ ৫০ হাজার পুলিশকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলব, যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন। এই মুহূর্তে এটাই আমাদের ধ্যান-জ্ঞান। সবাইকে শেখাতে হবে। নির্বাচন আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন, সেখানে কীভাবে একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব পালন করতে হয় সেজন্য আমরা সার্বিক সহযোগিতা করব।”
আগামী মাস থেকে নতুন গাড়ি পাচ্ছে পুলিশ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে গণরোষের মুখে পড়া পুলিশের কয়েক শ’ যানবাহন পুড়িয়ে ফেলাসহ ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে থানা ও ব্যারাকসহ পুলিশের নানা স্থাপনাও। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত থানাসহ নানা স্থাপনায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু হলেও যানবাহন পায়নি পুলিশ। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনে এটা বড় বাধা। পুলিশের এই যানবাহন সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে চার শতাধিক গাড়ি কেনার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যানবাহনসহ অন্যান্য লজিস্টিক সহায়তার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, “লজিস্টিক নিয়ে আমরা বিশেষ কিছু ভাবছি না। এটা নিয়ে তো শুরু থেকেই আলোচনা-উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেসব পেলেই আশা করছি আর লাগবে না। আমরা আশা করছি আগামী মাস থেকেই আমরা নতুন গাড়ি পাওয়া শুরু করব।”

নতুন চাপ দেখছি না, দেড় লাখ পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়াটাই চাপ: আইজিপি
আইজিপি বলেন, “নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে বিশেষ কোনো চাপ দেখছি না। বরং নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য দেড় লাখ পুলিশকে সক্ষম করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যারা নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত হবেন। এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এটা তো বিশাল কর্মযজ্ঞ, চাপের ব্যাপার। আমাদের নিয়মিত মাসের ৩০ দিনই প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নইলে আমরা শেষ করতে পারব না। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, ভূমিকম্প যা-ই আসুক না কেন! আমরা এখন থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করছি। যারা ফিরে গিয়ে আটটি বিভাগের, ৬৪টি জেলায় প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করবেন। সেটাই আমরা করছি। এটা তো চ্যালেঞ্জিং।”
বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব: ইসি মাছউদ
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, “অবশ্যই আমি মনে করি বর্তমান পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা বা বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। কারণ, আমি মনে করি পুলিশ বাহিনী যখন যা কমান্ড করা হয় সে অনুযায়ী চলে। নতুন কমান্ড অনুযায়ী পুলিশ এখন চলছে। কমান্ড বা পরিস্থিতি বদলালেও দায়িত্ব কখনো বদলায় না। নির্বাচনকালে যখন সেই দায়িত্ব আমরা দেব এবং আমরা যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে আশ্বস্ত করতে পারি তাহলে খুব ভালোভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। আর এর মধ্য দিয়ে পুলিশকে নিয়ে জনগণের যে ধারণা সেটা পরিবর্তিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
সংজ্ঞা বদলেছে, আইনগতভাবেই নির্বাচনের ডিউটিতে থাকবে সেনাবাহিনী
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ বলেন, “আগে নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকত সেনাবাহিনী। অর্থাৎ সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনীকে হায়ার করা হতো। এখন আইনগতভাবেই সেনাবাহিনী নিয়মিত ডিউটিতে থাকবে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো শঙ্কা থাকছে না বলেই আমি বিশ্বাস করি। নির্বাচনী আইনের সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী এখন নিয়মিত ফোর্স।”
নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে পুলিশের জন্য কমপক্ষে ৪০ হাজার বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় এই পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়

প্রিসাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় ‘অস্ত্রধারী আনসার’, থাকবে পুলিশও
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় ‘অস্ত্রসহ আনসার’ সদস্য রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি মাসে সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “নির্বাচনের সময় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আনসার। এবার আমরা আরেকটা জিনিস করছি, অন্য সময়ে থাকে না, এবার প্রিসাইডিং অফিসারকে নিরাপত্তা দিতে হাতিয়ারসহ আনসার থাকছে। অনেক সময় প্রিসাইডিং অফিসারের ওপর (লোকজন) হামলা করতে যায়। এজন্য উনার জন্য হাতিয়ারসহ একটা গার্ডের ব্যবস্থা করছি। উনাকে কেউ যেন কোনো কিছু না করতে পারে।”
এর আগে প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রে চারজন নারী ও ছয়জন পুরুষ আনসার সদস্য দেওয়া হতো, যাদের কাছে হাতিয়ার থাকত না। হাতিয়ারসহ থাকত দুজন আনসার সদস্য। এবার হাতিয়ারসহ তিনজন আনসার সদস্য থাকবেন। আনসার ছাড়াও পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েনের আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ বলেন, “শুধু আনসার নয়, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য একজন অস্ত্রধারী আনসার সদস্য নিযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। যাতে করে কোনো প্রিসাইডিং অফিসার নিরাপত্তাহীনতা বোধ না করেন বা পরাধীন মনে না করেন। তারা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।”

স্থল ও নৌ-সীমান্তবর্তী এলাকায় মোতায়েন থাকবে বিজিবি-কোস্ট গার্ড
নৌ ও স্থল-সীমান্তবর্তী এলাকায় আগে থেকেই মোতায়েন থাকত বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও আনসার সদস্যরা। এবারও তারা থাকবেন। তবে, তাদের দায়িত্ব পালনে এবার সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ আরও স্বাচ্ছন্দ্য হবে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ।
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পুলিশ পাবে বডি ক্যামেরা
নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে পুলিশের জন্য কমপক্ষে ৪০ হাজার বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় এই পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এ বিষয়ে সভায় উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ তৈয়ব আহমেদ জানান, ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা, যা সাধারণত বডিক্যাম নামে পরিচিত, সংগ্রহের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই ডিভাইসগুলো হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করবে। বডিক্যামগুলো দ্রুত ক্রয় এবং হাজার হাজার পুলিশ কর্মীর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।

ছাত্র-জনতার গণরোষের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে ভেঙে পড়েছিল পুলিশের চেইন অব কমান্ড। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সার্বিক অবনতি পরিস্থিতি থেকে আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুলিশের নেতৃত্বে আসে আমূল পরিবর্তন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। তবুও গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরেও নানা কারণে পুলিশ ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে ধরে আনা আসামিকে থানায় হামলা করে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ও পরবর্তীতে লুণ্ঠিত সব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রেও ভুগছে পুলিশ। মব ভায়োলেন্স, হত্যা, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা যেমন উদ্বেগ বাড়িয়েছে, তেমনি তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, অপরাধীসহ জেল থেকে পালিয়েছে অনেক জঙ্গি, যাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিনিয়তই উদ্বেগজনক অবনতির খবর আসছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ‘ঝুঁকি বাড়াতে পারে লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র’
গত বছরের ৫ আগস্ট থানা ও স্টেশনগুলো ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল পুলিশ সদস্যরা। লুট হয়েছিল তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। লুণ্ঠিত অস্ত্রের একটি অংশ উদ্ধার হলেও এখনো প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। যেগুলো অপরাধীদের কাছে চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। আগামী নির্বাচনের আগে এই অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্যানুসারে, ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টির মধ্যে ৪৬০টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ ধরনের প্রায় ছয় হাজার অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা।

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত লুণ্ঠিত চার হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি এক হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, লুণ্ঠিত ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টির মধ্যে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “যেসব অস্ত্র হারিয়ে গেছে বা লুট হয়েছে তা উদ্ধারের ব্যাপারে একটি পুরস্কারও ঘোষণা করা হচ্ছে। যারা সন্ধান দিতে পারবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। দুই-এক দিনের মধ্যে এটি জানানো হবে।” নির্বাচনের আগে এই অস্ত্র উদ্ধারের আশার কথা বলেন তিনি।
সুষ্ঠু-স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনে কমিটমেন্ট জরুরি
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ বলেন, “পলাতক অপরাধী, জঙ্গি বা দাগি আসামিদের গ্রেপ্তার কিংবা লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারা, না পারার চেয়ে জরুরি হচ্ছে আমাদের শক্তিশালী কমিটমেন্ট। কী হতে পারে, না পারে সেটা তো হাইপোথিটিক্যাল। আমরা বিশ্বাস করি, যারা কমান্ড দেবে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন থেকে ‘আনবায়াসড’ নির্দেশনা যাবে। কারো কথা না শুনে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদেশ দেওয়া হবে। আমাদের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা খুব শক্তভাবেই নেওয়া হবে। কয়েকজন অপরাধীর জন্য কিছু ঘটবে বলে আমি মনে করি না। এই কমিশনের প্রতি সবার আস্থা থাকবে বলে বিশ্বাস করি।”
নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায় সবার
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমি তো কোনো বাধা দেখছি না। সরকার তো সময় দিয়েছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব শুধু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। এটা সবার দায়িত্ব।”
নির্বাচন বিতর্কিত হবে বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি— উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া সঠিক পথেই আছে। এখন সবার সহযোগিতা করা উচিত।”

নির্বাচন পেছালে আরেকটা রক্তগঙ্গা বইবে: তোফায়েল আহমেদ
যারা নির্বাচন পেছাতে চায় তারা ঐতিহাসিক ভুল করছে— উল্লেখ করে এ নির্বাচন ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ বলেন, “নির্বাচন যে কোনো প্রকারেই হোক করে ফেলতে হবে। সেজন্য সবার সহযোগিতা করা উচিত। এটা একবার পিছিয়ে গেলে বা বিঘ্নিত হলে দেশে আরেকটা রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো কারণে যদি শতভাগ ফেয়ার নির্বাচন নাও হয়, ৮০/৯০ শতাংশ স্বচ্ছ তো হবে! যারা নির্বাচন পেছানো বা এই বাধা ওই বাধার কথা বলে তারা ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বলেন। যে সময়টা আছে সবাই আন্তরিক হলে ভালো একটি নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।”