
‘আগামী বছর রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ঈদ করবে।’ গত মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিবের কক্সবাজার সফরের সময় এমন মন্তব্য করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপরের পাঁচ মাসে নতুন করে আরও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ২০১৭ সালে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরুর পর পেরিয়ে গেছে আট বছর। মানবিকতা বিবেচনায় তৈরি করা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বর্তমানে অর্থ সংকটে ভুগছে। সংকট তৈরি হয়েছে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে।
রাখাইন রাজ্যসহ গোটা মিয়ানমারে সংঘাতের অবসান না হওয়ায় থমকে আছে প্রত্যাবাসনের আলোচনা। প্রশ্ন উঠছে, এ অবস্থায় বাংলাদেশ আর কতদিন রোহিঙ্গাদের ভার বহন করতে পারবে? প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নই বা কতদূর?
২০১৭ সালে রাখাইনে হওয়া ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’ স্মরণে গতকাল সোমবার কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে সমাবেশ করেছেন হাজারো শরণার্থী। তারা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছেন। হাতে থাকা ব্যানারে ইংরেজিতে লেখা ছিল, তারা আর শরণার্থীর জীবন চান না। প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। এই স্লোগান বার্তা দেয়, রোহিঙ্গাদের অনেকেও সমস্যার সমাধান চাচ্ছে।
প্রত্যাবাসন কেন হচ্ছে না
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরতে না পারার অন্যতম কারণ সেখানকার রাজনৈতিক বাস্তবতা। দেশটি এখনও সামরিক শাসনের অধীনে এবং রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখা যায়নি।
বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ অন্তত দুইবার শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ তৈরির আহ্বান জানিয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে ও পরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
ভূরাজনীতি ও খনিজ সম্পদের সহজলভ্যতা বিবেচনায় মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় আছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু ছাপিয়ে মিয়ানমার ঘিরে বড় শক্তিগুলোর এক প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।
গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের আগে রাখাইনে ফিরতে শঙ্কায় আছে অনেক রোহিঙ্গাও। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার ওয়াশিংটনে বড় ধরনের ও শক্তিশালী লবিস্ট নিয়োগ করেছে। পাশাপাশি নিজ দূতাবাসকেও শক্তিশালী করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দুই পক্ষ থেকেই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া এবং স্বাভাবিক করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য জবাবদিহি ও প্রত্যাবাসন দুই-ই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
তদন্ত ও বিচারে ধীরগতি
সোমবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারাও। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আগে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার তদন্ত করছে জাতিসংঘ। এই তদন্ত দলের প্রধান সম্প্রতি রয়টার্সকে বলেছেন, ন্যায় বিচারের প্রচেষ্টা দুর্বল হওয়ার পথে। কারণ, দাতারা কয়েক কোটি ডলারের তহবিল কমিয়েছে। জাতিসংঘের ব্যয় সংকোচনও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ ব্যাহত করতে পারে।
মিয়ানমারের জন্য জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থার প্রধান নিকোলাস কুমজিয়ান বলেছেন, তাদের কাজের পরিধি কমে যাওয়ায় অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তদন্তের গতি কমে গেলে অপরাধীদের কাছে একটি বার্তা যাবে। সেটি হলো, ‘অভিযোগ গঠন হওয়ার বিষয়ে চিন্তা করো না।’
ভবিষ্যৎ হুমকিতে
রোহিঙ্গা সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশু ও নারীরা। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুনেই রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় সাড়ে চার হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, কাজ হারিয়েছেন ১ হাজার ২০০ শিক্ষক। ফলে কন্যশিশুদের বাল্যবিবাহ ও ছেলেদের শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে মানবিক সংকট শুধু আশ্রয় বা খাদ্যের ঘাটতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি পুরো প্রজন্মের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।
বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য বাংলাদেশের পক্ষে অতিরিক্ত সম্পদ বরাদ্দ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন।
শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও শাসনব্যবস্থায়ও চাপ সৃষ্টি করছে বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, আমাদের নানা রকম চ্যালেঞ্জের কারণে দেশীয় উৎস থেকে অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহের কোনো সুযোগ দেখছি না।
এদিকে স্থানীয়দের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। কক্সবাজারে চাকরির বাজার থেকে শুরু করে জমি ও সম্পদের ব্যবহার পর্যন্ত টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের জন্য মানবিক দায়িত্ব পালন এবং নিজস্ব নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা-এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
এরপর কী হতে পারে
বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট সামনে আসতে পারে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও দাতা সংস্থাগুলো যদি অর্থায়ন বাড়ায় তাহলে সাময়িকভাবে সংকট নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, আসিয়ান ও জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ালে প্রত্যাবাসনের পথ খুলতে পারে। এরই মধ্যে আসিয়ানের সদস্য কয়েকটি দেশ মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মিশন পাঠাতে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা। তৃতীয়ত, যদি প্রত্যাবাসন বাস্তবসম্মত না হয় তাহলে বাংলাদেশকে সীমিত পরিসরে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তির চাপে পড়তে হতে পারে। যদিও এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বেশ জটিল।