
যুবকের পরনে লাল রঙের চেক শার্ট-ট্রাউজার। যুবতীর পরনে লাল রঙের সালোয়ার ও ছাই রঙের গেঞ্জি। যুবকের বয়স ৩৫ ও যুবতীর বয়স প্রায় ৩০ বছর। যুবকের হাতের সঙ্গে যুবতীর এক হাত বাঁধা ছিল। দু’জনের মরদেহ পাশাপাশি ভাসছিল বুড়িগঙ্গা নদীতে। খবর পেয়ে নৌ-পুলিশ সদস্যরা শনিবার সাড়ে ৭টার দিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন কালিন্দী ইউনিয়নের মাদারীপুর ঘাট থেকে মরদেহ উদ্ধার করে। নৌ-পুলিশ জানিয়েছে, মরদেহ উদ্ধারের কয়েকদিন আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। লাশ ফুলে যাওয়ায় চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একইদিন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ কোল্ড স্টোরেজের কাছ থেকে ভাসমান অবস্থায় প্রথমে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই নারীর গলায় কালো রঙের বোরকা প্যাঁচানো অবস্থায় ছিল। ওই নারীর লাশ উদ্ধারের এক ঘণ্টা পরে একইস্থান থেকে ওড়না দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় এক ছেলে শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত নারীর বয়স আনুমানিক ৩০ বছর ও শিশুটির বয়স ৩ থেকে চার বছর। নিহত নারীর পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। একদিনে চার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় কাউকেই শনাক্ত করতে পারেনি।
শুধু ওই চারজনের নয়। গত সাড়ে তিন বছরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদী থেকে অন্তত ৭৫০টি মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌ ও থানা পুলিশ। তিন নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা ঘটলেও এর সঠিক পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই। তবে এই তিন নদীর বিভিন্ন প্রান্তের থানা পুলিশ ও নৌ-পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত উদ্ধার করা ৭৫০ মরদেহের মধ্যে অন্তত পাঁচ শতাধিক মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। অনেক মরদেহ দাবিদার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া ও দাবিদার না থাকায় বাকি মরদেহ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার ভেতর ও পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই তিন নদী মরদেহ গুম করার ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও আশেপাশের জেলায় মানুষ হত্যা করে মরদেহ তিন নদীতে ফেলে দেয় অপরাধীরা। মরদেহ গুমের ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশি ছিল বলে চাউর রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা বেড়ে গেছে। কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ জানিয়েছে, প্রায়ই প্রতিদিনই মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে। ২/৩টি মরদেহ প্রায়ই উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের সূত্র বলছে, অপরাধীরা অন্য জায়গায় খুন করে মরদেহ নদীর নির্জন স্থানে নিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। নদীতে লাশ ফেললে স্রোতের টানে এক এলাকার মরদেহ আরেক এলাকায় চলে যায়। অনেক সময় মরদেহ টুকরো করে বস্তাবন্দি করে ফেলে। আবার অনেক সময় পুরো মরদেহ বস্তায় ভরে ইট-পাথর দিয়ে ভারী করে পানিতে ফেলে দিলে ডুবে যায়। তবে অনেক সময় মরদেহ পানিতে ভেসে ওঠে। নদীতে যেসব মরদেহ ভেসে ওঠে সেগুলো কয়েকদিন আগের মৃত থাকে। কয়েকদিন পানিতে থাকায় মরদেহের চেহারা বিকৃত হওয়ার পাশাপাশি গলে পচে যায়। বিকৃত চেহারা স্বজনরা শনাক্ত করতে পারেন না। এ ছাড়া ডিজিটাল পদ্ধতিতেও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে শনাক্ত করা যায় না। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলামত নষ্ট করে হত্যাকারী নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হত্যা মামলা ও ইউডি মামলা হয়। হত্যা মামলায় তথ্য প্রমাণ পরিচয় শনাক্ত না হওয়াতে মামলার কূলকিনারা করতে পারেন না তদন্তসংশ্লিষ্টরা। পচে গলে যাওয়াতে মেডিকেল রিপোর্টেও ভালো ফলাফল আসে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, কয়েক বছর থেকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি অপরাধীরা বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য নদীতে ফেলে দিচ্ছে। আর নদীতে ফেললে অনেক সময় লাশ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। মেডিকেল রিপোর্টেও ভালো কিছু আসে না। লাশ টুকরো করে বস্তাবন্দি করে নদীতে ছেড়ে দিলে অপরাধীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। বহু বছর ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও নৌ-পুলিশকে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, এসব অপরাধ বন্ধ করার জন্য নৌ-পুলিশ থানা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া নৌ- পুলিশের সঙ্গে একেবারে নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও জীবিকা অর্জন করে এমন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তাই তারা এসব বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। বেশি লাশ উদ্ধার হয় এমন কিছু এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে। পাশাপাশি নৌ- পুলিশকে প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে তদন্ত করতে হবে।
অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়াতে অপরাধীরা লাশ গুম করার জন্য নদীকে বেছে নেয়। কারণ নদীর অনেক এলাকা নির্জন থাকে। আর লাশ নদীতে ফেলে দিলে সেটি স্রোতের টানে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় চলে যায়। আর কয়েকদিন গেলে লাশ পচে ফুলে গিয়ে বিকৃত হলে পরিচয় পায় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তখন অপরাধীরাও আড়ালে থেকে যায়। তিনি বলেন, নদী পথে আরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি ও পেট্রোলিং বাড়ানো দরকার।
নৌ-পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান মানবজমিনকে বলেন, নদীতে লাশ পাওয়া গেলে সেটা নির্ভর করে কোন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। যদি শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় তবে আমরা হত্যা মামলা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেই। আর আঘাত পাওয়া না গেলে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষা করি। রিপোর্টে যা আসে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি বলেন, নদীতে যেসব লাশ মিলে সেগুলো অনেকদিন আগের হওয়াতে গলে-পচে যায়। তাই অনেক সময় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। আঙ্গুলের ছাপ নেয়া যায় না। চেহারাও বিকৃত হয়ে যায়। তবে যেসব লাশ শনাক্ত করা যায় সেগুলো আত্মীয়স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। অপরাধীরা নিজেদের অপরাধ লুকাতে অন্য স্থানে হত্যা করে বস্তাবন্দি করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয় বলেও জানান নৌ-পুলিশের এই কর্মকর্তা।