
কিন্তু এই অর্জনের পথ একেবারেই মসৃণ নয়। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো আশঙ্কা করছে, অর্থনীতি এখনও এলডিসি-পরবর্তী প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত নয়। রফতানি আয় হ্রাস, ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্ব সংকট, জ্বালানি ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বিনিয়োগ স্থবিরতা নিয়ে তাদের ভয় ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মতে, নির্ধারিত সময়ে উত্তরণ ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসতে পারে।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাল্টা শুল্কারোপ, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার অবনতি, জ্বালানি সংকট ও দুর্নীতির কারণে বেসরকারি খাতের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণে অন্তত তিন বছর সময় বাড়ানো প্রয়োজন।
রবিবার (২৪ আগস্ট) ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ আরও তিন থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দেশের শীর্ষ ১৬টি বাণিজ্য সংগঠন।
জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বাংলাদেশ বের হবে। সেই হিসাবে হাতে সময় আছে মাত্র ১৫ মাস। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, এই স্বল্প সময়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, অন্তত পাঁচটি কারণে এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়া জরুরি। এগুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক মোকাবিলায় ইইউ, যুক্তরাজ্য, আসিয়ান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি (এফটিএ) সম্পাদন করা। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশল খাতে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা মেটাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, বিশেষত অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই)। গুণগত মানসম্পন্ন প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা। সুশাসন জোরদার করা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করা।
এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণকে সমর্থন করি। তবে সফল ও টেকসই উত্তরণের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের অতিরিক্ত সময় অপরিহার্য। এ সময়ের মধ্যে সরকার ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতে পারবে।”
অপরদিকে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, পিছিয়ে যাওয়া মানে দুর্বলতার পরিচয়। ২০২৬ সালেই নির্ধারিত সময়ে উত্তরণ ঘটবে, সেই লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
ফলে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক দ্বৈত সংকটে— পেছালে ‘দুর্বলতার পরিচয়’, আর না পেছালে সামনে ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’।
উত্তরণ পেছানোর সুযোগ অক্টোবর-নভেম্বরে
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) প্রতিবছর সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, মানবসম্পদ সূচক ও পরিবেশগত ঝুঁকি মূল্যায়ন করে। অক্টোবর-নভেম্বরেই বাংলাদেশ চাইলে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময়ই হবে সর্বশেষ কার্যকর জানালা। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে পরবর্তী সময়ে আবেদন করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে সরকার মনে করছে, চাইলে যেকোনও সময়ই আবেদন করা সম্ভব।
সরকারের অবস্থান: ‘পেছানো মানে দুর্বলতা’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘‘দুর্বল হবে না। এলডিসি উত্তরণের পথ থেকে ফেরার সুযোগ নেই। এখন যদি পিছাই, সবাই আমাদের নিয়ে হাসবে।”
তিনি পোশাকশিল্প মালিকদের সমালোচনা করে আরও বলেন, “৫০ বছর ধরে তারা এলডিসি সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু বাজার ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারেননি। কোভিড-১৯-এর কারণে ইতোমধ্যে দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এত সময়েও যদি প্রস্তুতি না থাকে, তবে দায় কার?”
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনও একই সুরে বলেছেন, পিছিয়ে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা সরকারের নেই। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময়েই উত্তরণ জরুরি।
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা: রফতানিতে বড় ধাক্কা
বাংলাদেশের অর্থনীতি রফতানিনির্ভর। বর্তমানে মোট রফতানির ৮১ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। অথচ উত্তরণের পর এই খাতেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসার শঙ্কা রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন: শুল্কমুক্ত সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত থাকবে, এরপর ধীরে ধীরে তা বন্ধ হবে। যুক্তরাজ্য: সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ শুল্ক আরোপ হতে পারে। কানাডা: শুল্কের হার দাঁড়াতে পারে ১৮ শতাংশ। জাপান: ১২.৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে বছরে প্রায় ৫৩৭ কোটি ডলার রফতানি আয় কমতে পারে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা মনে করছেন, রুলস অব অরিজিন ও উচ্চ কমপ্লায়েন্স খরচের কারণে পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা আরও হ্রাস পাবে।
ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব সংকট
বাংলাদেশ বর্তমানে এলডিসি মর্যাদার কারণে বিশ্ববাজারে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। ট্রিপস চুক্তির আওতায় মেধাস্বত্ব আইন মানতে হয় না। এর ফলে ক্যানসার ও এইচআইভি-এইডসসহ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সস্তায় উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু উত্তরণের পর এই অব্যাহতি শেষ হবে। তখন বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালটি দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের মতে, এতে একদিকে ওষুধের দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে, অপরদিকে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল রফতানিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অভ্যন্তরীণ সংকট: জ্বালানি, মুদ্রা ও বিনিয়োগ
ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, চ্যালেঞ্জ শুধু রফতানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একাধিক অভ্যন্তরীণ সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে—
জ্বালানি সংকট: বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করছে।
মুদ্রার অবমূল্যায়ন: ২০২১ সাল থেকে টাকার মান প্রায় ৪৫ শতাংশ কমেছে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা: ২০২৪ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যেখানে একই সময়ে ভিয়েতনাম পেয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা: খেলাপি ঋণ ও অনিয়ম ব্যবসায়ীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে।
এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এখনই উত্তরণ ঘটলে এসব চাপে দেশের শিল্প খাত ভেঙে পড়তে পারে।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব: সময় বাড়ানোই সমাধান
আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, “উত্তরণ অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এই প্রক্রিয়া সফল করতে অন্তত ৩-৫ বছর সময় বাড়ানো প্রয়োজন। নাহলে শুল্ক আরোপ, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ হ্রাস দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করবে।”
ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিচ্ছেন, মালদ্বীপ, ভানুয়াতু, নেপালসহ একাধিক দেশ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে উত্তরণ পিছিয়েছে। বাংলাদেশও চাইলে একই সুবিধা চাইতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত: পেছানো নয়, প্রস্তুতিই মূল
অর্থনীতিবিদরা অবশ্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের শর্ত পূরণ করেছে। এখন মূল কাজ হলো— রফতানি বহুমুখীকরণ, জিএসপি প্লাসের মতো নতুন বাজার সুবিধা অর্জন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।”
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, “অক্টোবর-নভেম্বরে সরকারের হাতে আবেদন করার সুযোগ আছে। তবে রফতানি, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বাড়ছে। সেক্ষেত্রে পেছানোর জন্য শক্ত যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।”
আগের নজির: কারা পিছিয়েছে
জাতিসংঘের এলডিসি উত্তরণ থেকে নানা কারণে পিছিয়েছে একাধিক দেশ। অ্যাঙ্গোলা: তেলের দামের পতনে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। নেপাল: ভয়াবহ ভূমিকম্পে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়। সলোমন দ্বীপপুঞ্জ: গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। মিয়ানমার: সামরিক অভ্যুত্থানের পর সিডিপি নিজেই পিছিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দেশের ক্ষেত্রে ছিল অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়। বাংলাদেশ যদি পেছাতে চায়, তবে শক্তিশালী যুক্তি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন হবে।
লাভ-ক্ষতি: দুই দিকেই যুক্তি
সম্ভাব্য ক্ষতি: রফতানিতে বছরে প্রায় ৫৩৭ কোটি ডলার হ্রাস। ওষুধশিল্পে পেটেন্ট আইন কড়াকড়ি, দাম বৃদ্ধি
সহজ শর্তে ঋণ ও ভর্তুকির সুযোগ সীমিত হবে।
সম্ভাব্য লাভ: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদা বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা বিনিয়োগকারীদের আস্থা জোগাবে। বড় অঙ্কের ঋণ ও উন্নয়ন সহযোগিতা পাওয়া সহজ হবে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
ভয় নাকি সুযোগ?
বাংলাদেশের জন্য এলডিসি থেকে উত্তরণ একদিকে স্বপ্ন পূরণের মতো অর্জন, অপরদিকে বড় পরীক্ষার মঞ্চ। ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত হয়ে সময় বাড়ানোর দাবি তুলছেন। সরকার বলছে— পিছিয়ে আসা মানেই দুর্বলতার পরিচয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনও প্রস্তুতির সময় আছে, তবে যৌক্তিকতা ছাড়া পিছিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
এই প্রেক্ষাপটে মূল প্রশ্ন একটাই—বাংলাদেশ কি সাহসিকতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নির্ধারিত সময়ে উত্তরণ ঘটাবে, নাকি ব্যবসায়ীদের ভয়ই প্রাধান্য পাবে?