Image description

বিদ্যুৎ নিয়ে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের করা অসম চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ থমকে গেছে। বর্তমান সরকারের নেওয়া এ উদ্যোগ ব্যর্থ করার জন্য অদৃশ্য শক্তির কারসাজি জোরেশোরে কাজ করছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাত করে চুক্তিটি বহাল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে, চুক্তিটি বহাল রাখতে বিপুল অঙ্কের ঘুস লেনদেন হচ্ছে।

এ সম্পর্কে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নেওয়া অনুসন্ধান কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও অনশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী আদানি গ্রুপের এ চুক্তি আদৌ বাতিল হবে কি না, সে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি সম্পাদন করেন। ‍চুক্তিটি ছিল পুরোপুরি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। চুক্তিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ও আমদানি করা কয়লার দাম অস্বাভাবিক বেশি দেখানো হয়। তাছাড়া বিদ্যুৎ চুক্তিটিও করা হয় ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে। ওই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সাবেক মন্ত্রী-সচিবসহ অন্যরা। শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস একাই বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে দেড়শ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। আত্মঘাতী এ চুক্তির ফলে আগামী ২৫ বছরে ভারতের আদানি গ্রুপকে বাংলাদেশের প্রায় ২৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। চুক্তিটি বহাল থাকায় প্রতি মাসে সরকারকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করে আদানির বিদ্যুৎ আনতে হচ্ছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট বিদ্যুৎ নিয়ে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে উচ্চপর্যায়ের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। নির্দেশে হাইকোর্ট বলেছিল, অনুসন্ধান কমিটিতে আন্তর্জাতিক জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞ রাখতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এক মাসের মধ্যে কমিটি গঠন করে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ নিয়ে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে অসম চুক্তি বাতিল করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছিল হাইকোর্ট। আদালত আরো নির্দেশ দিয়েছিলÑভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির সময় যে দরকষাকষি হয়েছিল, তার নথিপত্র এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে হবে। এর পরে দীর্ঘ সাত মাস পার হয়েছে।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরামর্শে বিদ্যুৎ বিভাগ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। বিাগ কমিটি হাইকোর্টে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনও দাখিল হয়। কিন্তু এরপরই দৃশ্যত থমকে যায় এ বিষয়ে সরকারের সব কর্মকাণ্ড। চুক্তি নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। হাইকোর্টেও তৎপরতা নেই।

এ সম্পর্কে রিটকারী আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ুম জানান, আমি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চসহ একাধিক বেঞ্চে বিষয়টির শুনানির জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো বেঞ্চই বিষয়টি শুনতে আগের মতো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে আমি ভীষণ হতাশ ও বিমর্ষ।

আদানির বিদ্যুৎ কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত শেখ হাসিনা

আদানি গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এস আলম ও সামিট গ্রুপের সঙ্গে বিতাড়িত হাসিনা সরকারের সব চুক্তি সম্পাদনে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। এতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রী, সচিব ও অন্য নির্বাহীরা বিভিন্ন অভিনব পন্থায় বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন। পতিত শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে আদানি চুক্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

তার মুখ্য সচিব কায়কাউস একাই বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির মাধ্যমে দেড়শ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেন। জানা গেছে, তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। সরকার যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিষয়টি উত্থাপন করেছে কি না, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা জানাতে পারেনি। তবে তিনি যে চুক্তিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সরাসরি অর্থ গ্রহণ করেছেন, তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, আদানি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও সামিট গ্রুপ নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয় এবং এ দুর্নীতি পরিকল্পনায় সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে অবস্থানকারী আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক দালালচক্রের সহায়তা গ্রহণ করে।

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার আদানি গ্রুপের আত্মঘাতী বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিলে অতিসত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তা ড. ইউনূস সরকারের জন্য একটি বিশাল ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।

চুক্তির ফলে যে ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ

১৫৮ পৃষ্ঠার চুক্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় করা আত্মঘাতী চুক্তির কারণে ভারতের আদানি পাওয়ার বাংলাদেশ থেকে লুটে নেবে প্রায় চার লাখ কোটি টাকা। এ টাকা বিদ্যুতের দামের বাইরে। এরমধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ খাতেই বাংলাদেশকে গুনতে হবে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। বাকি প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা আদানিকে দিতে হবে কয়লার বাড়তি দাম হিসেবে। ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে এ লুটের অঙ্ক আরো বাড়তে পারে। উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার জেরে পতিত আওয়ামী শাসনে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৮৮ শতাংশ। উচ্চমূল্যের বিদ্যুতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ ও পণ্যমূল্য। পকেট কাটা হচ্ছে ভোক্তাদের। অপরদিকে খালি করে ফেলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।

বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৫৮ পৃষ্ঠার চুক্তিনামার প্যারায় প্যারায় বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। দেড় হাজার মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান ভারতের ঝাড়খণ্ডে। এতে বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা তদারক নেই। যদিও সেটির যাবতীয় দায় বাংলাদেশের আর সব সুবিধা ও মুনাফা যাচ্ছে এককভাবে ভারতের আদানি গ্রুপের পেটে।

তবে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছে, আদানির সঙ্গে হাইকোর্টের বর্ণিত অসম চুক্তিটি এখনো বাতিল করা হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই অসম চুক্তিজনিত রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। ভর্তুকি বাদ দিলে বাংলাদেশে বিদ্যুতের গড় ইউনিটপ্রতি মূল্য ভারতের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। আইএমএফ বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি তুলে দেওয়ার জন্য যে চাপ দিচ্ছে, তা গৃহীত হলে বিদ্যুতের মূল্য যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোমর ভেঙে যাবে। জনস্বার্থে, বিশেষ করে আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে সব অসম চুক্তি বাতিল করে বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার কাজটি অতিজরুরি হয়ে পড়েছে।

আমি হতাশ, বিমর্ষÑরিটকারী আইনজীবী

‘আদানির সঙ্গে করা চুক্তি লাখো-কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপরও বড় ধরনের আঘাত’Ñবিষয়টি তুলে ধরে চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ুম। ১৯ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী এবং অসম ও অন্যায্য এ চুক্তি বাতিল করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না’ এই মর্মে রুল জারি করে হাইকোর্ট। পাশাপাশি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে আদানি গ্রুপের সঙ্গে যে দরকষাকষি হয়েছিল, তার তথ্যউপাত্ত আদালতে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্বালানি এবং আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী যা আছে তা বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়। চুক্তির পদ্ধতি সম্পর্কে তদন্ত করতে আরেকটি কমিটি করতে বলা হয় হাইকোর্টের আদেশে।

আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে অ্যাডভোটে আবদুল কাইয়ুম আমার দেশকে বলেন, ‘আমি ভীষণ হতাশ ও বিমর্ষ। দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে এ চুক্তি করা হয়। আমরা উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছি। আদালত আদেশ দিলেও সেটি প্রতিপালন হলো কি না, একজন রিটকারী হিসেবে সবার আগে আমার জানার কথা। অথচ আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমাকে কোনো নথি বা তথ্য দেওয়া হয়নি। আদালতের আদেশের পর প্রায় আট মাস অতিবাহিত হতে চলল অথচ এ বিষয়ে কোনো তথ্যই পাইনি।

বিদ্যুতের দাম ও আদানি নিয়ে যা বলেছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা

আদানির অসম চুক্তির বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চুক্তির অসংগতি নিয়ে আদানির সঙ্গে পুনরায় আলোচনা হবে। দুর্নীতি এবং ঘুসের মতো অনিয়ম প্রমাণ হলে অবশ্যই চুক্তি বাতিল হবে। আদালতের নির্দেশে যে তদন্ত চলছে, তার ভিত্তিতেই এটি হবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আদানির উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৪ টাকা ২ পয়সা দরে আমদানি করে বাংলাদেশ। ভারতের যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে এটাই ছিল সর্বোচ্চ দাম। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৮ টাকা ৭৭ পয়সা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানির বিদ্যুতের দাম ১২ টাকায় নেমে এলেও তা ছিল ভারতের অন্যান্য বেসরকারি উৎপাদনকারীর তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। এ খাতে সরকারকে প্রতি বছর ৩২০ বিলিয়ন টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বলে জানান জ্বালানি উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, দাম বেশি হওয়ায় সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আমরা চাই বিদ্যুতের দাম শুধু আদানি থেকেই নয়, গড় খুচরা দামের নিচে নামুক।

বিদ্যুৎ প্রতারক আদানি সব দেশে ধরা পড়লেও ব্যতিক্রম বাংলাদেশ

ভারতীয় ধনকুবের আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ফেডারেল কৌঁসুলিরা গত বছরের নভেম্বরে ২৫৬ মিলিয়ন ডলার ঘুস লেনদেন ও প্রতারণার অভিযোগ তোলেন। এরপরই শনির দশা লাগে আদানির কপালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা চালাতে গিয়ে মারাত্মক সংকটে পড়ে গ্রুপটি। আদানি যুক্তরাষ্ট্রের এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও এরই মধ্যে ভারতের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্বিবেচনা করার ঘোষণা দেয়।

আদানির চুক্তি পর্যালোচনার সঙ্গে যুক্ত বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, আদানির প্রতারণামূলক ব্যবসা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বন্ড বিক্রির পরিকল্পনা বাতিল করতেও বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎলাইন নির্মাণের চুক্তি বাতিল হয় কেনিয়ায়ও। পাশের দেশ শ্রীলঙ্কাও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়ন করে।

সূত্র জানায়, আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ফ্রান্সের তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান টোটাল এনার্জিও।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আদানির বিষয়ে একমাত্র উদার দেশ হলো বাংলাদেশ। আদানির সঙ্গে করা বহুল বিতর্কিত বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি বাতিল বা পুনর্মূলায়নের ন্যূনতম উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। বরং আদানিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছে। আদানির বিতর্কিত এই চুক্তির বিষয়ে কঠোর কোনো অবস্থান নিতে না পারাকে সরকারের নতজানু নীতির প্রয়োগ হিসেবে দেখছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম।

অধ্যাপক শামসুল আলাম বলেন, দেশের এযাবৎকালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর মধ্যে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি ছিল বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক আত্মঘাতীমূলক। চুক্তিটি করা হয়েছিল দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত খায়েশে। চুক্তিটি বাতিল করার পক্ষে অসংখ্য যুক্তি থাকলেও এটি বহাল রাখার পক্ষে একটি যুক্তিও নেই।

তিনি বলেন, সরকার হয়তো তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করতে আদানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি অব্যাহত রেখেছে। অথচ এর অসংখ্য বিকল্প পদ্ধতি ছিল, সেগুলো অনুসরণ করা হয়নি। আদানির সঙ্গে শেখ হাসিনার করা চুক্তি বহাল রাখার পেছনে রাঘববোয়ালদের কারসাজি রয়েছে বলেও মনে করেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই বিশেষজ্ঞ।

১১ মাসেও রিপোর্ট তৈরি করতে পারেনি বিচারপতি মইনুল কমিটি

হাইকোর্টের আদেশের আগে আদানি গ্রুপসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সরকার গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়। এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান। কমিটিকে যে কোনো সূত্র থেকে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় যে কোনো নথি নিরীক্ষা করা, সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে তলব এবং বিশেষ আইন (ইনডেমনিটি) আইনের আওতায় করা চুক্তিগুলোয় দেশের স্বার্থরক্ষা হয়েছে কি না, তা নিরীক্ষা করার পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হয়।

এ কমিটি কার্যক্রম শুরু করার পর প্রায় ১১ মাস পার হয়েছে। এখন পর্যন্ত রিপোর্ট করতে তৈরি হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যেই দুই দফায় চিঠি দিয়ে রিপোর্ট পেশ করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

কমিটির কার্যক্রম ও রিপোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এত পরিমাণ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, যা যাচাই-বাছাই চলছে। চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করতে আরো সময় লাগবে। কতদিন সময় লাগতে পারেÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি। আরো কিছুদিন সময় লাগবে।

কমিটির অপর এক সদস্য জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তির সব নথি নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ব্যক্তিগত নথিও সংগ্রহ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সম্পাদিত হয়, পাওয়ার পারসেজ অ্যাগ্রিমেন্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্টসহ (পিপিএ) সম্পাদিত সব চুক্তি ও চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমোদন এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুকূলে পরিশোধ করা বিল ও বকেয়া বিলসংক্রান্ত তথ্যসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য তথ্যউপাত্তসহ এগুলো পর্যালোচনা, মূল্যায়ন, পরীবিক্ষণ সম্পন্ন করে রিপোর্ট তৈরি করতে একটু সময় লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, আদানির চুক্তি পর্যালোচনা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। এ লক্ষ্যে একটি কমিশনও গঠন করা হয়। কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেওয়া হয়েছে। এতে মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। ফলে কমিশনের কার্যক্রমে সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। কমিটি রিপোর্ট দিলে সে আলকে সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্ট কবে নাগাদ পাওয়া যাবেÑএমন প্রশ্নে পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় সব নথি কমিটির কাছে দিয়েছি। আশা করছি শিগগির প্রতিবেদন পেয়ে যাব।’

১৫৬ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নথি চেয়েও পায়নি দুদক

১৫৬ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‍দুর্নীতির ১৭২টি নথি তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশন বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানে পাঁচজন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও বিদ্যুৎ খাতের সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত বলে দুদকের হাতে অভিযোগ রয়েছে। ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে নথিগুলো তলব করা হয়।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আক্তারুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়, তার বেশিরভাগই বেসরকারি মালিকানাধীন। এসব কেন্দ্রের বিষয়ে ঘুস গ্রহণ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদন, সরকারি জমি দখল, ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে আত্মসাৎসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি, ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্টসহ সব ধরনের চুক্তির কপি, চুক্তির অনুমোদনসংক্রান্ত তথ্য এবং এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুকূলে পরিশোধিত বিল ও বকেয়া বিলের নথিও দিতে বলা হয়েছে। তবে দুদকের অপর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনুসন্ধান ও তদন্ত তো অনেক দূরের বিষয়, এখনো সব নথি এসে জমা হয়নি।

দুদকে নথি দেওয়ার বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব চুক্তির যেসব নথি দুদক চেয়েছে, আমরা যথাসময়ে সেগুলো দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারা যখন যেটা চাচ্ছেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তা দিচ্ছি।’

এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির খতিয়ান শ্বেতপত্রে

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে গত ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে এ দুই খাতে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়, যা দিয়ে তিন-চারটি পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত। এ দুর্নীতি মূলত হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কমিশন এবং কেন্দ্র ভাড়া ও অতিরিক্ত মুনাফাÑএ তিন খাতে।

সাড়ে ১৫ বছরের দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ওই আমলে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন ডলার সরাসরি লুট করা হয়। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুট করা হয় এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে মাত্রাতিরিক্ত দামে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয় অত্যন্ত গোপনে।

দুর্নীতির পরিসংখ্যান চিত্র তুলে ধরে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমার দেশকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে মোট খরচ করা হয় দুই হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময়হারে প্রায় তিন লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জে লুটপাট করা হয় এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

তিনি বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে লুট করা হয় এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে লুটপাট করা হয় ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। এর অর্থ বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলেনি এবং এ টাকা তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থ লুটের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, সামিট গ্রুপ নিয়েছে ১০ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল নিয়েছে সাত হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, আল্ট্রা পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে সাত হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, ইউনাইটেড গ্রুপ নিয়েছে ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা এবং আরপিসিএল নিয়েছে পাঁচ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার সরকার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা।

২০২৩ সালে সিঙ্গাপুরের ৫০ ধনী ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস। ওই তালিকার ৪১তম অবস্থানে ছিলেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। তালিকা অনুযায়ী, মুহাম্মদ আজিজ খানের মোট সম্পদের পরিমাণ এক দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিল সামিট গ্রুপ। তারা বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস, আবাসন ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে কাজ করে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, শেখ হাসিনার সরকার শুধু সামিট গ্রুপকে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১০ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার বেশি দিয়েছে।