Image description

তিন দশকের বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনে স্বতন্ত্র ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সমর্থিত সম্ভাব্য ছয় প্যানেল আলোচনায় রয়েছে। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা ধরনের তৎপরতাও শুরু করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি হতে যাচ্ছে দশম ছাত্র সংসদ নির্বাচন।

১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পরের বছর প্রথম জাকসু নির্বাচন হয়। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে বিরতি দিয়ে আরও আটবার নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন মাসুদ হাসান তালুকদার। আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হয়েছিলেন শামসুল তাবরীজ। 

জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষক ক্লাবে জাকসু নেতাদের নেতৃত্ব ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালান। এর জেরে প্রশাসন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ভেঙে দেয়। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি।

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ ও ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ থাকছে। আর ছাত্রদল সমর্থিত একটি প্যানেল থাকলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এখনো নাম ও প্রার্থীদের চূড়ান্ত করতে পারেনি সংগঠনটি। বামপন্থী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত হবে দুটি প্যানেল। আর গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক আব্দুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে একটা স্বতন্ত্র প্যানেল থাকবে।

সম্ভাব্য ছয়টি প্যানেল
এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, এবারের জাকসু নির্বাচনে সম্ভাব্য ছয়টি প্যানেল বিভিন্ন নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ ও ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ থাকছে। আর ছাত্রদল সমর্থিত একটি প্যানেল থাকলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এখনো নাম ও প্রার্থীদের চূড়ান্ত করতে পারেনি সংগঠনটি। 

বামপন্থী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত হবে দুটি প্যানেল। আর গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক আব্দুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে একটা স্বতন্ত্র প্যানেল থাকবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্যানেলগুলো চূড়ান্ত হবে।

বাগছাসের ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’
পদ নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও গত শুক্রবার জাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ নামে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে। ফোরাম থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন শাখার আহবায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম, এজিএস (পুরুষ) পদে জিয়া উদ্দিন আয়ান এবং এজিএস (নারী) পদে মালিহা নামলাহ নির্বাচন করবেন।

ক্রীড়া সম্পাদক পদে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবল দলের খেলোয়ার মাহমুদুল হাসান কিরণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম থেকে এ পদে কোনো প্রার্থী দেয়নি। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ তাদের প্যানেলকে বৈচিত্র্যময় ও ইনক্লুসিভ করার জন্য দলের বাইরে থেকে পাঁচ প্রার্থীকে প্যানেলে স্থান দিয়েছে। 

এর মধ্যে একজন কার্যকরী সদস্য হিসেবে নির্বাচন করবেন পৃষতী খান। তিনি বলেন, তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে আসছেন। তাই সার্বিক বিবেচনা করে এ প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন।

সহসভাপতি (ভিপি) পদের প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জল বলেন, ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ আত্মপ্রকাশের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দাবিদাওয়া, অ্যাকাডেমিক সংস্কার নিয়ে সরব ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি আমাদের ভোটের মাধ্যমে রায় দেন, তাহলে আমরা আরো বেশি করে কাজ করতে পারব।’

ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’
সবার আগে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে প্যানেল ঘোষণা করে আলোচনায় এসেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিনে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের তারা এ প্যানেল ঘোষণা করেন। তারা ছয় নারী শিক্ষার্থী নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষাণা করলেও নেই কোনো নৃগোষ্ঠী বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। শিবিরের প্যানেল স্থান পেয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান আহত, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীরা।

প্যানেলে কোনো নৃগোষ্ঠী বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী না থাকার বিষয়ে সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস পদপ্রার্থী এবং শাখা ছাত্রশিবিরের অফিস সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এখনো তো প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা নৃগোষ্ঠী কেউ যদি আমাদের জোটে আসতে চায়, আমরা তাকে ওয়েলকাম জানাব।’ 

প্যানেলের স্থান পাওয়া সবাই শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত কিনা জানতে তিনি বলেন, ‘প্যানেলের সবাই শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত নয়। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থী আমাদের প্যানেলে যারা এসেছে, তারা সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এসেছে। ক্যাম্পাসে যারা পরিচিত মুখ, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম ও সামাজিক সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছে, আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি যাদের ভালো লেগেছে। তারা আমাদের প্যানেলে এসেছে।’

শিবির সমর্থিত প্যানেল সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের এজিএস (মহিলা) প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা বলেন, ‘আমার সাথে একাধিক ছাত্র সংগঠন যোগাযোগ করেছে। সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট আমাকে কাঙ্ক্ষিত পদটি দিয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি প্যানেলের নেতাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি, তাদের নিজেদের ভেতর কোন্দল চলছে। তাই আমার মনে হয়েছে শিক্ষার্থী সমন্বিত জোটে গেলে আমি ভালো কিছু করতে পারব। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করতে পারব। এ কারণেই এ জোটে আমি যুক্ত হয়েছি।’

একাধিক পদপ্রত্যাশী ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্যানেল চূড়ান্ত হয়নি ছাত্রদলের
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সম্ভাব্য জোট ছাড়া পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও এক পদে একাধিক পদপ্রত্যাশী থাকায় এখনও প্যানেল ও প্রার্থী ঠিক করতে পারেনি দলটি। ফলে নেতাকর্মীরা  আলাদা আলাদাভাবে একাধিক পদের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। 

কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, একটি পদের জন্য একাধিক পদ প্রত্যাশী থাকায় প্যানেল গঠনে সময় নিচ্ছে শাখা ছাত্রদল। এছাড়া সংগঠন থেকে আগ্রহী প্রার্থীদের ইচ্ছামত মনোনয়ন সংগ্রহ করতেও বলা হয়েছে বলে জানা সূত্র জানায়। তবে কে কোন পদে পার্থী হবেন, সেটি এখনও ঠিক না হলেও তাঁরা সবাইকে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকার মধ্যে নিয়ে এসেছেন নেতারা।

সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে আলোচনায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুল গাফফার জিসান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সভাপতি হামিদুল্লাহ সালমান, কাজি নজরুল ইসলাম হলের সভাপতি মেহেদী হাসান ইমন, মীর মশাররফ হোসেন হলের সিনিয়র সহসভাপতি আরশাদ হাবিব বিশাল ও ১৩ নম্বর ছাত্রী হলের সভাপতি তানজিলা হোসেন বৈশাখী। 

শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, ‘আমরা আগামী দু-এক দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করব। একটি পদের জন্য একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকায় যাচাই বাছাই একটু সময় লাগছে। ইতোমধ্যে আমরা প্রার্থীদের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছি। চূড়ান্ত হলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা প্যানেল ঘোষণা করব।’

বামপন্থীদের মধ্যে ফাটল, হবে দুই প্যানেল
বামপন্থী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্যানেল হবে দুটি। একটি প্যানেলে শাখা ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সাবেক সভাপতি অমর্ত্য রায় ও সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি শরণ এহসানের নেতৃত্বে। এ প্যানেলের নাম হতে পারে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’। 

এ বিষয়ে অমর্ত্য রায় বলেন, ‘আমাদের প্যানেলের নাম সম্প্রীতির ঐক্য। সব মত ও পথের সহবস্থান নিশ্চিত করার আমাদের লক্ষ্য। ৫ আগস্ট পরবর্তী আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছি, তার একটি ছোট উদাহরণ হবে জাকসু। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের প্যানেল ঘোষণা করা হবে।’

বামপন্থীদের আরেকটা প্যানেলের নেতৃত্বে থাকবেন সাংস্কৃতিক জোট আরেক অংশের আহবায়ক মাহফুজ ইসলাম মেঘ ও শাখা ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ইমন। এ প্যানেলের সম্ভাব্য  নাম হতে পারে ‘শিক্ষার্থী ঐক্য সংসদ’। তাঁরা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক মিলিয়ে বিভিন্ন মতের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল সাঁজাচ্ছেন। তবে তারা আংশিক প্যানেলও দিতে পারেন।

এ বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম ইমন বলেন, ‘আমাদের প্যানেলে রাজনৈতিক মানুষের পাশাপাশি অরাজনৈতিক, কিন্তু ক্যাম্পাসের জন্য কাজ করতে চান তাদের নিয়েই প্যানেল হচ্ছে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠক, আদিবাসী এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিয়ে একটা ইনক্লুসিভ প্যানেল হচ্ছে।’

জিতু-শাকিলের নেতৃত্বে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্যানেল
গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক আব্দুর রশিদ জিতুর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁর নেতৃত্ব একটি স্বতন্ত্র প্যানেল হবে। এ প্যানেলে ভিপি পদে নির্বাচন করবেন তিনি নিজেই। জিএস পদে থাকবেন শাকিল আলী। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, আদিবাসী এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে কাজ করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করা হবে তিনি জানান।

যদিও এ পর্যন্ত কোনো প্যানেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানান শাকিল আলী। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও কোনো প্যানেল থেকে নির্বাচন করার কথা ভাবছি না। আপাতত এককভাবে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে আছি। শেষ পর্যন্ত যদি কাঙ্ক্ষিত কোনো প্যানেল পাই, তাহলে যুক্ত হতে পারি।’