
এইচএসসির প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে রিকশাযোগে বাসায় ফিরছিলেন এক কলেজ ছাত্রী। হঠাৎ কিছু না বলেই তার রিকশায় চেপে বসেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ, যিনি কিছুক্ষণ আগে তার পরীক্ষক ছিলেন। পরে রিকশা চলাকালে ওই পরীক্ষক চালাতে থাকেন যৌন হেনস্থা। কলেজ ছাত্রী পরীক্ষকের উদ্দেশ্য খারাপ বুঝে চিৎকার-চেঁচামেচি করলে পথচারীরা এসে তাকে উদ্ধার করে এবং সেই অভিযুক্ত শিক্ষককে শাহবাগ থানায় নিয়ে গেলে ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে অভিযোগ না করায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনই একটি গল্প জানিয়েছেন তুহিন কান্তি দাস নামে এক গণমাধ্যমকর্মী। তিনি জানান এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তার এক সহকর্মী।
রবিবার (২৪ আগস্ট) দিবাগত রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এ ঘটনার বিষয়ে জানান। এ স্ট্যাটাসে তিনি সেই অভিযুক্ত শিক্ষকের স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও যুক্ত করেন। যেখানে তার দোষ স্বীকার করতে দেখা গেছে।
অভিযুক্ত ওই শিক্ষকের নাম মো. গোলাম মোস্তফা। তিনি রাজধানীর সাইন্সল্যাবের আইডিয়াল কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
গণমাধ্যমকর্মী তুহিন কান্তি দাসের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
পরীক্ষার শেষ দিনে একজন নারী শিক্ষার্থীর বিভৎস অভিজ্ঞতা, শহরে নারী নিরাপত্তাহীনতা আর আমাদের আক্ষেপ!
এইচএসসি পরীক্ষার শেষ দিন। পরীক্ষার চাপে কাটানো কয়েক মাসের ক্লান্তি শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মুহূর্ত। পরীক্ষার শেষ প্র্যাক্টিকেল দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন রুমা (ছদ্মনাম), যিনি রাজধানীর একটি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তবে দিনটির স্বস্তি আর আনন্দ মুহূর্তেই রূপ নেয় এক ভয়ংকর বিভৎস অভিজ্ঞতায়। যে অভিজ্ঞতা শহরে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সবাইকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
রুমা পরীক্ষার পর রিকশায় উঠে রওনা দিয়েছিলেন বাসার পথে। গন্তব্য সেগুনবাগিছা। কিন্তু হঠাৎ করেই তার রিকশায় উঠে পড়ে এক আগন্তুক। অনুমতি ছাড়াই রিকশায় চেপে বসলেন একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্তব্ধ হয়ে যান সেই শিক্ষার্থী৷ হঠাৎ মনে পড়লো কিছুক্ষন আগেই পরীক্ষার হলে রুমার পরীক্ষক ছিলেন এই লোকটি। নাম মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। প্রথমে রুমা বিষয়টি বুঝতে পারেননি কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমা বুঝতে পারেন, এই ‘শিক্ষক’ শুধু নামেই শিক্ষক, চরিত্রে বর্বর।
শুরুতে বিষয়টা কীভাবে ঝামেলাবিহীন শেষ করা যায় সেই চেষ্টাই চালাচ্ছিলেন৷ রিকশা যতই এগোতে থাকে, মোস্তফার আচরণ হয়ে ওঠে ক্রমেই অস্বাভাবিক। কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, শরীরী ভাষা-সবই ছিল রুমার জন্য অস্বস্তিকর ও আতঙ্কের। এক পর্যায়ে শরীরে অস্বস্তিকর স্পর্শ টের পান৷ নারী শিক্ষার্থীটি প্রথমে লজ্জা ও ভয় পেলেও দ্রুতই পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করেন। তিনি বুঝতে পারেন এই ব্যক্তি একজন যৌন নিপীড়ক। বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন। যাকে আর কোনোভাবেই সহ্য করা যাচ্ছে না।
হতবাক হয়ে মুহূর্তেই রুমা চিৎকার শুরু করেন। আশপাশের পথচারীরা দ্রুত সাড়া দেন তার ডাকে। জনতার সহায়তায় অবশেষে সেই ‘শিক্ষক রূপী নিপীড়ক’ মোস্তফাকে রিকশা থেকে নামিয়ে আটক করা হয় এবং নিয়ে যাওয়া হয় নিকটস্থ পুলিশ বক্সে। মৎস ভবন পুলিশ বক্স৷ পরবর্তীতে পুলিশ এসে তাকে আটক করে নিয়ে যায়। তবে ঘটনা এইখানেই শেষ নয়!
দুপুর ১টা বাজে তখন ঘড়ির কাটায়৷ পুলিশ বক্সের সামনে উপস্থিত জনতার ভিড়ে কৌতুহল বসত উঁকি দিতেই দেখা মিলল এক জটলার৷ এই শহরের একজন ছাপোষা রিপোর্টারের চোখে ধরা পড়লো এমন বিভৎস ঘটনা যা কিছুক্ষণ আগে একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘটে গেছে৷ দেখা গেলো শিক্ষক রূপী সেই নিপীড়কেরও৷ এই ঘটনা বাস্তবতায় সেখানে এসে উপস্থিত হন ঐ নারী শিক্ষার্থীর পিতা৷ কিন্তু পিতা কোনভাবেই কোন লিখিত অভিযোগ বা কথা বলতে অপরগতা জানান৷ খুবই স্বাভাবিক, আমাদের সমাজে অপরাধীর চেয়ে ভিক্টিম ব্লেমিংই বেশি হয়৷ হয়তো ঘটনা সামনে আসলে নিপীড়কের চেয়ে শিক্ষার্থীর চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ শুরু হয়ে যেতো আর পরিবারকে সেই হেসেল নিতে হতো৷ সুতরাং কী দরকার, হজম করে নেওয়াই ভাল তাই করেছে শিক্ষার্থী এবং তাঁর পিতা। এই অবস্থায় পুলিশের বক্তব্যই এই ভয়াবহ ঘটনার বৈধতা দিতে পারে৷ কী ঘটেছে পুলিশ বললেই নিউজ দাঁড়ায়ে যায়৷ সাংবাদকর্মী হিসেবে অকাট্য প্রমাণ থাকার পরেও পুলিশের ভাষ্য লাগবে৷ যেহেতু অভিভাবক কথা বলতে অপারগ দায়িত্বরত পুলিশের বক্তব্য পেলেই হয়৷ কর্মব্যস্ত ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে আরেকটা নিপীড়নের দু:সাহসিকতা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠতেই পারতো৷ কিন্তু কিছুই হল না। দিনশেষে কিছুই হয় না যদিও৷ শহরের আরেকটা যৌন নিপীড়নের মতোই দুই চারদিন আলাপ-আলোচনা।
যৈক্তিকভাবে সাংবাদ প্রকাশ করতে হলে পুলিশের বক্তব্য সংগ্রহ করা প্রধান দায়িত্ব হয়ে উঠলো রিপর্টারের। কিন্তু বিধি বাম! এতো বড় নারী নিপীড়নের ঘটনা অপ্রকাশ্যেই থেকে গেল৷ কেননা পুলিশ কথা বলবে তো দূরে থাক উলটো ভিডিও করা থেকে বিরত থাকতে থ্রেট দিতে শুরু করলেন। কারণ ততোক্ষণে উপস্থিত পুলিশ পরিদর্শকের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ফোনে৷
অকাট্য প্রমাণসহ ভিডিও হাতে আছে কিন্তু অভিভাবক বা ভুক্তভোগী অভিযোগ নাই এবং পুলিশের বক্তব্য পাওয়া গেল না৷ একদিকে পুলিশের বক্তব্য নেই অন্যদিকে ভুক্তভোগী বক্তব্য দিতে অপারাগ; একপাক্ষিক নিউজ হয়ে যায়। দিনে দুপুরে রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তায় একটি বর্বর ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলো এক রিপোর্টার৷ পুলিশের গাড়িতে করে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল শাহবাগ থানার দিকে৷ বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না যে তাকে মূলত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এক নিপীড়ককে দেওয়া হয়েছে প্রশ্রয়। আর অসহায় রিপোর্টার তাকিয়ে তাকিয়ে হজম করলো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অন্যায়৷
পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এক সহকর্মী। আমার মাথায় ঘুরতে থাকলো, সেই শিক্ষার্থী আর তার অভিভাবক পিতা হয়তো এখনো সেই ট্রমাতেই আছে৷ ভাবা যায় কতটা অনিরাপদ আমাদের শহর! নিপীড়িক শিক্ষিকের নাম-পরিচয় আর তাঁর ভিডিও-স্বীকারোক্তি হাতে আছে কিন্তু ভুক্তভোগীর অভিযোগ নেই, নেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের বয়ান৷ অতএব নিউজ বাদ! ভাবছিলাম আমিও চেপে যাবো। এমন অনেক ঘটনাইতো আমাদের মা-বোনেরা প্রতিনিয়ত চেপে যাচ্ছেন৷ কিন্তু আমি আর পারলাম না। কেননা নিপীড়ক একজন শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি অধ্যয়নরত সুশিক্ষিত নাগরিক। দিন দুপুরে রাস্তায় একজন উচ্চশিক্ষিত নিপীড়ককে সামনে আনতেই হচ্ছে। কেননা এই শিক্ষক নিশ্চয়ই এই ঘটনার পর থেমে থাকবেন না। নিশ্চয়ই তিনি এমন নিকৃষ্ঠ কাজ করার চেষ্টা করবেন ভবিষ্যতেও।
এবার আসি তার পরিচয়ে। অভিযুক্ত ব্যাক্তি পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি সাইন্সল্যাবের আইডিয়াল কলেজের বায়োলজি বিভাগের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে কর্মরত আছেন। এবং এই ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োলজি বিভাগে পিএইচডি অধ্যয়নরত। নাম মো. গোলাম মোস্তফা। জানি কিছুই হবে না। তবুও শিক্ষকরূপী নিপীড়কের চরিত্রটা প্রকাশ করতেই হল শেষ পর্যন্ত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক বা রাস্তাঘাট-নারীদের চোখে অনিরাপত্তার কথা প্রায় সময় শুনি। কিন্তু রাস্তা ভরা মানুষের মাঝে যখন এমন কিছু করার সাহস রাখে যে মানুষ সে নির্জন স্থান কিংবা রাতের অন্ধকারে হায়নায় পরিণত হতে খুব একটা সময় নেওয়ার কথা না৷ আর এই সমস্ত মানুষ যখন হয় শিক্ষক কিংবা পিএইচডি অধ্যয়নরত পার্ভার্ট৷ ঘটনাকে আড়াল করে (যা করেছে শিক্ষার্থী এবং তাঁর অভিভাবক পিতা) এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের এমন দায়িত্বহীন আচরণ দিয়ে সেটা সম্ভব না। তাই প্রকাশ করলাম৷ কিছু মানুষ অন্তত সতর্ক হোক।
পরীক্ষা শেষের দিনটা রুমার জীবনে আনন্দের হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত মোস্তফাদের মতো মানুষরুপী যৌনসন্ত্রাসীদের কারণে রুমার মতো অনেকের জীবনে নেমে আসে আজন্ম অন্ধকারের ছায়া। আজ যেমন জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরেও বেঁচে ফিরেছেন রুমা। অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো এমন হয়না। রুমার মতো এমন ঘটনা হয়তো অহরহ ঘটছে এর প্রতিকার কী, চুপ করে থাকা?
আমি আমার দায় থেকে প্রকাশ করলাম। বাকিটা আপনাদের বিবেচনা৷ যদি বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা আইডিয়ালের কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা শিক্ষার্থীদের নজরে আসে...। ভিডিও গ্রহীতা এবং ভুক্তোভোগী শিক্ষার্থীর নাম গোপন রাখা হয়েছে সঙ্গত কারণেই।