
দুজন নাইটগার্ড, একজন অফিস সহকারী, একজন ক্যাশিয়ার আর একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মাত্র এই ৫ জন জনবল দিয়েই চট্টগ্রামে চলছে একশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক। ব্যাংক পরিচালনার জন্য রয়েছে ব্যবস্থাপনা বোর্ডও! বোর্ডে রয়েছেন একজন চেয়ারম্যান ও ৫ জন পরিচালক। এই ৬ জনের মধ্যে আবার দুজন সরকারি প্রতিনিধি। ব্যাংকটির ৪৫ বছর ধরে কোনো ঋণ কার্যক্রম নেই। গ্রাহকের সঙ্গে নেই সংযোগ। তবে ব্যাংকের শত কোটি টাকার সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা অফিস-বাসা-দোকানপাটের যে ভাড়া আসে সে টাকারও সদ্ব্যবহার করছেন না কর্মকর্তারা। উলটো নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে এই টাকার সিংহভাগ লুটপাট করা হচ্ছে। আয়ের টাকা সরকারি কোষাগারে বা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা না রেখে করা হচ্ছে আত্মসাৎ। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটিতে ডেপুটেশনে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে আছেন সাজ্জাদ হোসেন। এছাড়া আছেন ক্যাশিয়ার সবুজ। সরকারি দুই প্রতিনিধির মধ্যে রয়েছেন সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক কানিজ ফাতেমা ও পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন।
জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের নিবন্ধিত ১০৩টি সমিতি রয়েছে। ২০২৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের সাধারণ সভায় (এজিএম) ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের হিসাবে প্রারম্ভিক হস্তে মজুত দেখানো হয় ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯১০ টাকা এবং সমাপ্তি হস্তে মজুত ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৫০৪ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হস্তে মজুত রাখা যায়। এই টাকা ব্যাংকের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এজিএমে।
এছাড়া ভবন মেরামত, ছাপা ও মনিহারি, কন্টিজেন্সি, যাতায়াত ও আপ্যায়ন খাতে যে ব্যয় দেখানো হয় সেখানেও বিপুল অঙ্কের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। অভিযোগ তদন্তের জন্য কানিজ ফাতেমাকে আহ্বায়ক করে নিরীক্ষা কমিটি করা হয়। কিন্তু সমিতির সদস্যরা অভিযোগ করেন, কানিজ ফাতেমা তদন্ত না করে উলটো অভিযুক্তকে বাঁচাতে নানা কৌশল করতে থাকেন। সাজ্জাদ হোসেনকে ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে প্রত্যাহার করা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে সেই অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই তাকে আবারও একই পদে ডেপুটেশনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে একজন সদস্য কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগে বলা হয়, ব্যাংকের ইতিহাসে ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা হস্তে মজুতের নজির নেই। এই টাকা ব্যবস্থাপনা কমিটি, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ক্যাশিয়ার মিলে আত্মসাৎ করেছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভবন সংস্কার খাতে ২১ লাখ ১৭ হাজার ১০০ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৩৭৫ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। এখানেও বাড়তি ব্যয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ভবন মেরামত খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ লাখ ১৭ হাজার ১০০ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। আপ্যায়ন খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় দেখানো হয় ২ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকা। এছাড়া ২০২২ সালে এজিএমের ব্যয় দেখানো হয় ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৩ টাকা। অভ্যন্তরীণ অডিট ভাতা দেখানো হয় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। বিশেষ অতিথির আপ্যায়ন দেখানো হয় ৮০ হাজার ৬৯৫ টাকা। তখন ব্যাংক পরিচালনা ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীন। কিন্তু বিগত নির্বাচনে তার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হলে তিনি আদালতে মামলা করেন। সরকারি দুই প্রতিনিধি এবং সমিতির তিনজন প্রতিনিধি মিলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করা হয়। এই ৫ জন মিলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে কো-অপ্ট করেন অ্যাডভোকেট আবছার উদ্দিন হেলালকে। নির্বাচন ছাড়া বোর্ডে এভাবে কো-অপ্ট করার সুযোগ নেই বলে দাবি অভিযোগকারীর।
সমিতির সদস্য আকতার আহমেদ চৌধুরী এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পান সমবায় অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-নিবন্ধক জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সমবায় ব্যাংকের বিষয়ে আমি তদন্ত শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে অভিযোগকারীকে ডেকে বক্তব্য নিয়েছি। অভিযুক্তদেরও ডাকা হবে।
সমবায় ব্যাংকের সরকারি প্রতিনিধি কানিজ ফাতেমা বলেন, তাকে আহ্বায়ক করে দুর্নীতি তদন্তে যে কমিটি করার কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ সত্য নয়। অভিযোগের তদন্ত চলছে। অ্যাড. আবছার উদ্দিন বলেন, পদ শূন্য থাকায় ব্যবস্থাপনা বোর্ডের অন্য সদস্যরা বিধিসম্মতভাবে আমাকে চেয়ারম্যান হিসাবে কো-অপ্ট করেছেন। তবে ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে নিজেও হতাশ। কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্যাংকের নামে বদনাম করছেন। এখানে যা হচ্ছে তা আইনসম্মতভাবে হচ্ছে। লুটপাটের সুযোগ নেই।