Image description
জাতীয় নির্বাচন সামনে তিন চ্যালেঞ্জ-বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা বৃদ্ধি, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে জ্বালানির দামে অস্থিরতা * ব্যাংকে তারল্য বাড়ায় স্বস্তি, তবে কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা দিতে পারেনি

আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করা কঠিন হবে। পাশাপাশি প্রত্যাশিত হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও কঠিন হবে। প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে উন্নত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, উন্নত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিত করার ওপর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নির্ভর করছে। এছাড়া অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে আগামীতে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এগুলো হচ্ছে-বৈশ্বিকভাবে সৃষ্ট বাণিজ্য উত্তেজনা, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে চলমান ও ভবিষ্যতে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জ্বালানিসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহে বাধা ও জ্বালানি তেলের দামে অস্থিরতা।

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রোববার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এটি প্রতি তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৫ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আগামী নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এর আলোকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, আগামীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশে ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকায় ও ডলারের প্রবাহ বাড়ায় আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। বৈশ্বিকভাবে আমদানি পণ্যের দাম কমেছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে। এ ধারা আগামীতেও যাতে অব্যাহত থাকে এজন্য কঠোর মুদ্রানীতি চলতি অর্থবছরেও অনুসরণ করা হচ্ছে। দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হারও আরও কমে আসবে। এ হার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নেমে আসতে পারে। মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশিত মাত্রায় কমে গেলে মুদ্রানীতির কঠোরতা কিছুটা শিথিল করা হবে। যাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদের হার কমতে শুরু করেছে। আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে এলে নীতি সুদের হার কমানো হবে। তখন ঋণের সুদের হারও কমবে।

সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমলেও আলোচ্য সময়ে মানুষের খাদ্যের প্রধান উপকরণ চালের মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি তেল ও চর্বিজাতীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে মাছের মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং ফলের মূল্যস্ফীতি ১৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ দশমিক ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ওইসব খাদ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। যা ভোক্তাকে আক্রান্ত করেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। সরকার নীতি সহায়তা দিয়ে এ খাতকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু গত ১৫-১৬ বছর অর্থনীতি একভাবে চলেছে। ওই সময়ে যারা অর্থনীতির বেসরকারি খাতের নেতৃত্বে ছিলেন তারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হয় হারিয়ে গেছেন অথবা জেলে রয়েছেন। যে কারণে বেসরকারি খাতে মন্দা চলছে। এতে পুরো অর্থনীতি আক্রান্ত হয়েছে। এখন অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত বেসরকারি খাত পুরোপুরি সক্রিয় না হবে ততদিন পর্যন্ত অর্থনীতি পুরো মাত্রায় গতিশীল হবে না।

মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির নজির রয়েছে। অতীতে যেমন হয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখেও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হতেই পারে। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আমরা অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদই ব্যক্ত করতে পারি। এর বেশি কিছু করা যাবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের আগেও অর্থনীতির গতি কিছুটা স্তিমিত ছিল এখনো তাই আছে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা গর্তে ঢুকে যায়। দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ কালোটাকানির্ভর। ফলে কালোটাকার আর চলাচল হয় না। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যায়। এখনো তাই হচ্ছে।

তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বেশকিছু খাতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক চাপ বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়ে গেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট, যা সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করতে পারে এবং জ্বালানির দামকে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এতে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, ধারণা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে চলমান কাঠামোগত এবং নীতি সম্পর্কিত সংস্কারগুলো অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।

তবে প্রতিবেদনে এটিও বলা হয়েছে, দীর্ঘকাল ধরে সংকোচনমুখী আর্থিক নীতি অনুসরণের ফলে ঋণ বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বা অর্থনৈতিক প্রাণবন্ততা সীমিত হতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে গেলে মুদ্রানীতির কঠোরতা ধীরে ধীরে আরও বেশি সহনশীল করবে। অর্থাৎ সুদের হার কমাবে। এই ধরনের নীতি গ্রহণের পর বেসরকারি খাতের ঋণের বিকাশকে উৎসাহিত করবে এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে আরও প্রসারিত করতে সহায়ক হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক গতিপথকে উন্নীত করতে হলে আর্থিক খাতে চলমান কাঠামোগত সংস্কার, উন্নত মুদ্রা সঞ্চালন চ্যানেলের সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ।

সামনের দিকে তাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদি পূর্বাভাসে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামীতে ক্রমাগত হারে মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস পাবে এবং দেশীয়ভাবে কৃষি উৎপাদনে প্রত্যাশিত ভালো ফলন হবে। শিল্প খাতেও উৎপাদন বাড়ছে। তবে প্রবৃদ্ধিতে শিল্প খাতের অবদান কমে গেছে। বড় শিল্প খাতের উৎপাদন কিছুটা কমলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ভালো করছে।

ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও শতকরা হার দুটোই বাড়ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর লাভজনকতা হ্রাস পেয়েছে। আমানত বৃদ্ধির ফলে ব্যাংক খাতে স্বস্তি এসেছে। তবে, আলোচ্য সময়ে কিছু ব্যাংক তারল্যের ঘাটতিতে ভুগতে থাকে। এই ব্যাংকগুলো কখনো কখনো ওভার দ্য কাউন্টার উইন্ডোতে অর্থাৎ গ্রাহকদের চেকের বিপরীতে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের গ্রাহকদের অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়। যা আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে।

ব্যাংকগুলোর সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয় এবং আমানতকারীদের তাদের আমানতের নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুর করেছে, অন্যদিকে অন্যান্য ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আস্থা হ্রাসের ফলে তারল্য ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিদায়ি অর্থবছরে সরকারকে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে মোকাবিলা করতে হয়েছে। একদিকে সরকারি খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে রাজস্ব আয় কমেছে। ফলে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। এদিকে ব্যাংকে তারল্য সংকটের মধ্যেও সরকার বেশি ঋণ গ্রহণ করায় বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান রেকর্ড পরিমাণে কমেছে।

গত অর্থবছরে মোট সরকারি ব্যয় বেড়েছে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। একদিকে ব্যয় বেড়েছে বেশি, অন্যদিকে রাজস্ব আয় কম হয়েছে। ফলে সরকারের ঘাটতি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নের বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হয়েছে। প্রধানত ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ঘাটতি মিটিয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ঋণ নেতিবাচক ছিল এবং পর্যালোচনাধীন বিদেশি অর্থায়নও ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে সরকারকে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছে।