
‘যাওয়ার পর থেকেই আমি অবৈধ। যে এজেন্সি দিয়া গেছি তারাও আর খোঁজ নেয় নাই। পালিয়ে আর কত কাজ করা যায়? শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই ধরা দেই পুলিশের কাছে। জেল খেটেছি ছয় মাস। এখন শূন্য হাতে বাড়ি ফিরলাম।’
কথাগুলো বলছিলেন চাঁদপুরের রাসেল আহমেদ। গায়ে থাকা পোশাক আর একটি মোবাইল ছাড়া সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি সৌদি আরব থেকে।
অবৈধ হওয়ার কারণে গত ১৯ আগস্ট সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত আসেন রাসেলসহ ১৯ জন বাংলাদেশি।
সৌদি আরবে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন রাসেলের মতো প্রবাসীরা। ভোগান্তির শিকার হয়ে কেউ বাধ্য হয়ে কেউবা আবার জেল খেটে দেশে ফেরত আসছেন। প্রতারণায় নিঃস্ব হয়ে দেশে এসেও পড়েছেন কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তায়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এজেন্সিগুলো মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ভালো বেতনের চাকরির আশ্বাস দিলেও বাস্তবে সৌদি আরবে কাজের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্ধারিত বেতন তো দূরের কথা, কাজই মিলছে না। একই সঙ্গে ইকামাও (সৌদিতে থাকার বৈধতা) মিলছে না। ফলে অবৈধ হয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে প্রবাসীদের। অনেকে অবৈধ অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে দেশে ফেরত আসছেন।
সৌদি থেকে ফেরত আসা রাসেল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গিয়ে কাজ পাবো না, অবৈধ থাকতে হবে এমন জানলে কখনোই যেতাম না। এলাকার এক দালালের হাত ধরে কাকলি নামে এক এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যাই। তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছিল আমাকে। সৌদি যাওয়ার পর আর তারা কল ধরেনি। কী করবো, এভাবে আমি তিন বছর ছিলাম। খরচ হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা।’
সৌদিতে দুই বছর জেল খাটার পর গত ১৮ আগস্ট ফেরত আসেন গাজীপুরের রুবেল হোসেন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে এজেন্সি আমাকে কোম্পানির ভিসায় হোটেলে চাকরি দেবে বলে পাঠায়। পরে গিয়ে দেখি সাপ্লাই কোম্পানি। এক সপ্তাহ এক ধরনের কাজ। ঠিক মতো নেই বেতন। ইকামা (সৌদি আরবে কর্মরত ও বসবাসকারী প্রবাসীদের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা একটি আবাসিক পারমিট এবং সরকারি পরিচয়পত্র) চাইছি অনেকবার, তাও দেয়নি। কারণ ইকামা দিলে অন্য কোথাও চলে যাবো। এসব কারণে তারা দেয় না। কিন্তু তাদের ওখানে মানুষকে গাঁধার খাটুনি খাটায়, কিন্তু বেতন নেই।’
রুবেল হোসেন জানান, এজেন্সির কথামতো সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়ে সৌদি যান তিনি। এজেন্সির প্রতিশ্রুতি ছিল কাজ দেবে হোটেলে, বেতন হবে তিন হাজার রিয়াল। তার কোনো কিছুই মানা হয়নি।
“সেখানে গিয়েই এজেন্সির দালালকে জানাই। পরে দালাল বলেন, ‘এখন তো কিছু করার নেই। যে কাজ দিছে সেটা করো, নাহলে ফেরত চলে এলে তোমারই লস।’ যাওয়ার প্রথম দুই বছরে মাত্র দুই লাখ টাকা বেতন পেয়েছি। এরপর জেলে যাওয়ার পর তো আয় বন্ধ। আমার পরিবার ছিল এতদিন অসহায়। এখন দেশে কী করবো? আমি শূন্য হাতে এসেছি। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের এক হাজার টাকা ভাড়া দিয়েছে বাড়ি পৌঁছার জন্য।” বলছিলেন রুবেল হাসেন।
৬ মাসে ফিরলেন অন্তত ২৫ হাজার
বাংলাদেশের অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণ, মানবপাচার প্রতিরোধ এবং বিদেশফেরত অভিবাসীদের সহায়তা করে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। তাদের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে শুধু সৌদি আরব থেকেই ফেরত পাঠানো হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মীকে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে ফেরত এসেছে আরও অন্তত ২৫ হাজার কর্মী।
সৌদি থেকে অবৈধ হয়ে ফেরত আসা কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তারা জানিয়েছেন, সৌদি আরবের একেকটা ভিসার খরচ পড়ে চার থেকে সাত লাখ টাকা। অথচ সেখানে গিয়ে দালাল কিংবা এজেন্সির প্রতিশ্রুত কাজ পাওয়া যায় না। ঋণ কিংবা কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে যাওয়ার সিকি ভাগও তুলতে পারছেন না অনেকে। তার আগেই ইকামা না থাকা কিংবা নানান অজুহাতে সৌদির পুলিশ ধরে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।
অভিযোগ বেশি সৌদি প্রবাসীদের
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে প্রবাসী কর্মী, স্বজন ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের অভিযোগ এসেছে ২১৮টি। এর মধ্যে ১৬১টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে এখনো বিএমইটির অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সেলে তিন হাজার ৩৮০টি অভিযোগ জমা রয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরব সম্পর্কিত অভিযোগ রয়েছে এক হাজার ৮৬০টি, মালয়েশিয়ার এক হাজার ৩২৪টি। এছাড়া বাকি সব দেশে মিলিয়ে ১৯৬টি।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ম্যানেজার আল আমিন নয়ন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে। অথচ দেশের এই সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার থেকে প্রতিদিনই শত শত বাংলাদেশি শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনেকের বৈধ ইকামা থাকা সত্ত্বেও তাদের গ্রেফতার ও ডিপোর্ট করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ প্রতিনিয়তই পাওয়া যাচ্ছে। রাষ্ট্র যদি এই সংকটকে গুরুত্ব সহকারে না নেয়, তবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গোটা শ্রমবাজার ও দেশের মর্যাদায়।
আল আমিন আরও বলেন, শ্রমবাজার ধরে রাখা কোনো একক কর্মীর নয় বরং রাষ্ট্রের স্বার্থ। বছরের পর বছর ধরে এই ডিপোর্ট করা শ্রমিকদের কান্না, আহাজারি, প্রতিবাদ সবকিছুই যেন রাষ্ট্র উপেক্ষা করছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংগঠন বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সৌদির শ্রমবাজারে এমন প্রতারণা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। কর্মীদের ভোগান্তিরও শেষ নেই। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের পর্যাপ্ত তদারকির অভাব এবং নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানের সঠিক যাচাই না থাকা এই দুরাবস্থার মূল কারণ।’
কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণার দায় সৌদিরও রয়েছে উল্লেখ করে ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে সৌদিরও দোষ আছে। তারা যে এত হাজার হাজার লোকের ভিসা দিচ্ছে, তাদের কাজ নেই, ফ্যাক্টরি নেই, ইকামা দিতে পারে না। শুধু কি ভিসা বাণিজ্য করছে? আমাদের প্রশাসন তো সৌদির সঙ্গে এসব বিষয়ে বসছে না।’
ফখরুল ইসলাম বলেন, সৌদির মতো এতো অভিযোগ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নেই। প্রতারিত হয়ে মানুষ অভিশাপ দিচ্ছে। আমাদের এজেন্সিগুলোর উচিত যেখানে কর্মী পাঠাবে সে যেন ভালো থাকে এটা নিশ্চিত করা। এটা তার ব্যবসার জন্যও ভালো।
‘এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সরকারকে অভিযোগ করতে হবে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে যেসব কোম্পানির অ্যাকোমোডেশন নেই, বেতন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তাদেরকে যেন ভিসা বের করার ক্ষমতা না দেওয়া হয়। তাদের যেন আমাদের হাইকমিশনের মাধ্যমে সিলগালা করা হয়। সৌদি প্রশাসনের উচিত এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা। তবে সবার আগে আমাদের কর্মীদের সচেতন হতে হবে’, যোগ করেন ফখরুল ইসলাম।
সৌদির সঙ্গে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ মিটিংয়ের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের উচিত সৌদির সঙ্গে বসা। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং করা৷ তারা হাজার হাজার ভিসা দিচ্ছে, তাহলে কর্মীরা কেন কাজ পাচ্ছে না?
সৌদি নির্ভর শ্রমবাজার ব্যবস্থাও দায়ী
ফখরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সৌদি যাওয়ার প্রবাহ কিন্তু আগের তুলনায় কমেছে। মানুষ কাজ না পেলে গিয়ে কী করবে? আমাদের কয়েকটি শ্রমবাজার বন্ধ। কিছু শ্রমবাজারে বিশৃঙ্খলার কারণে লোক যাচ্ছে না। সরকার তো নতুন শ্রমবাজার খুলতে পারছে না। অন্যান্য দেশের কর্মী না যাওয়ায় সৌদিতে চাপ বাড়ছে। ফলে এজেন্সিগুলো সৌদিতে লোক পাঠিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করছে।’
এদিকে, এজেন্সি ও দালাল চক্রের মিথ্যা প্রলোভনকে কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সৌদি আরবের শ্রমবাজারের এমন হয়রানি কিংবা প্রতারণা দীর্ঘদিনের। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিদেশগামী মানুষের সঙ্গে নির্মম আচরণ করছে। যারা ঋণ করে কিংবা শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে বিদেশ যান, প্রতারিত হয়ে তারা আরও নিঃস্ব হয়ে যান। এজেন্সিগুলোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও হাইকমিশনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যা মোকাবিলা করা অসম্ভব।