Image description

মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ১২ লাখের বসবাস এখন বাংলাদেশে। তারা মূলত কক্সবাজার ও ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে শরণার্থীর জীবনযাপন করছে। তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বেশির ভাগের জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। তবে এক বছরের ব্যবধানে তাদের সহায়তা নেমেছে অর্ধেকের নিচে। এতে তহবিল ঘাটতিতে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য পরিচালিত অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। নভেম্বরের পর রোহিঙ্গাদের খাদ্যের সংস্থানেও বড় সংকটের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোহিঙ্গাদের সহায়তায় গঠিত আন্তর্জাতিক তহবিলে শুরু থেকেই একটি বড় অংশের জোগান দিত যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থার (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে মোট মানবিক সহায়তা এসেছে ৬৭ কোটি ৯২ লাখ ডলার, যার ৮০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। মোট মানবিক সহায়তার ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৩৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

ওসিএইচএর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ২২ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা এসেছে ৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। এ অর্থের ৯৩ শতাংশের বেশি বরাদ্দ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। মোট তহবিলের মাত্র ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের কিছু বেশি অর্থের জোগান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তা এক বছরের ব্যবধানে অর্ধেকের নিচে নেমেছে। জাতিসংঘ ও মানবিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সতর্ক করেছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নিকট ভবিষ্যতে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য বরাদ্দ আরো সংকুচিত করা ছাড়া বিকল্প নেই। এতে শরণার্থী শিবিরে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও নারীদের জন্য এ পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট ইউনূস আরমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু সামনে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। কারণ মানুষ খাদ্য না পেলে কাজের খোঁজে ক্যাম্পের বাইরে যাবে। এখনো কেউ কেউ বাইরে কাজের চেষ্টা করে। তখন স্থানীয়দের সঙ্গে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। ইউনিসেফ সাড়ে তিন লাখ শিশুর জন্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করত। সেই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব শিশু এখন পড়াশোনার মধ্যে নেই। অনেক এনজিও কার্যক্রম সীমিত করেছে। হেলথ সাপোর্ট কমে গেছে। অনেক মাদক কারবারি রোহিঙ্গাদের সীমান্তে মাদক বহনের কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এসব করতে গিয়ে অনেকে বিজিবির কাছে ধরা পড়ছে। ফান্ড যদি না আসে তাহলে সামনে এসব সমস্যা আরো বাড়বে। সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।’

সহায়তা কমে যাওয়ায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক এনজিও প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষা কার্যক্রম ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে রোহিঙ্গা কিশোর-তরুণরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যে কাজগুলো করছি, সেগুলোর জন্য প্রতিশ্রুতি বছরের শুরুতেই হয়ে গেছে। ফলে প্রতিশ্রুতির ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। এখন পর্যন্ত ব্র্যাকের কাজ মোটামুটি আগের মতোই চলছে। আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের মতো করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আগামী বছরের প্রতিশ্রুতি আসন্ন সেপ্টেম্বরের মধ্যে হওয়ার কথা। সেই জায়গায় বড় একটা ঘাটতি পড়তে পারে বলে ধারণা করছি। সমগ্র রোহিঙ্গা সহায়তার প্রায় ৪০ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এবং তারা যদি আর সহায়তার প্রতিশ্রুতি না করে, যার সমূহ সম্ভাবনা আছে—তাহলে এর ফল হবে ভয়াবহ। এরই মধ্যে অর্থ কমে আসাটা জাতিসংঘের ইউনিসেফের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে। তাদের হোস্ট কমিউনিটির স্কুলগুলো বন্ধ করতে হয়েছে। সেগুলো নিয়ে বড় ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। আগামী বছর সবারই কার্যক্রম সংকুচিত করার একটা ব্যাপক সম্ভাবনা আছে।’

বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিশ্রুত সহায়তা যথাসময়ে না দিলে শরণার্থী শিবির পরিচালনা ও মানবিক চাহিদা পূরণ করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়বে।

জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গতকাল রাতে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ডের ৮০ শতাংশের বেশি খাদ্যসহায়তা। মনে হচ্ছে এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে সেটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু ১২ ডলার দেয়া হয়। নভেম্বরের পরে সম্ভবত ডব্লিউএফপি সেটি কাট (হ্রাস) করবে। ফলে খাদ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। অন্যান্য সেবার মধ্যে শিক্ষায় এরই মধ্যে প্রভাব পড়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউনিসেফ, তারা হোস্ট কমিউনিটির টিচারকে রীতিমতো চাকরিচ্যুত করেছে। ৫০ শতাংশের বেশি স্কুল এখন বন্ধ। স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, সেক্সচুয়াল রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ, ওয়াশ ফ্যাসিলিটি—এগুলোয় প্রভাব পড়বে। ইউএনএইচসিআর প্রটেকশন খাতে যে কাজগুলো করে সেগুলোয় বড় প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের সঙ্গে অন্য দাতাদের তহবিলেরও সংযোগ রয়েছে। ইইউ এবং ইউকেও অনুদান কমিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু নেতৃত্ব দেয়, ফলে তাদের সহায়তা কমে যাওয়ার একটা বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। তাদের অনুসরণ করে অন্য দাতারাও সহায়তা কমিয়ে আনে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। এ বিষয়ে সরকার বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় পরিসরে তিনটি সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর প্রথমটি আজ কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে। চলতি বছর নিউইয়র্ক ও দোহায় আরো দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সম্মেলনটি আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বিদেশী প্রতিনিধিদের কাছে তাদের সমস্যা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নকে তুলে ধরার সুযোগ পাবেন। এ সম্মেলনগুলো আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা সংকটকে তুলে ধরা।

শরণার্থী বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, আজ শুরু হওয়া সম্মেলনের মাধ্যমে সংকটের হালনাগাদ পরিস্থিতির চিত্র উঠে আসবে, যা আসন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অর্থসহায়তা পুনর্বিন্যাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বৈশ্বিকভাবেই কমানো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা আবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সব জায়গায় হ্রাস এক রকমভাবে হবে না। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও তারা এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন এক বছরের একটা পরিকল্পনা হয়, জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান। এবারেরটা গত বছরের শেষ দিকে করা হয়েছিল। সেটা এখন একটা পরিবর্তিত পরিকল্পনার মধ্যে আছে। সেখানে অবশ্যই একটা ঘাটতির জায়গা আছে। সংস্থাগুলো কোনো না কোনোভাবে কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। আগামীতে দুটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আছে, যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম মূল সংগঠক। আজ যে সম্মেলন শুরু হচ্ছে সেখানে আসন্ন দুটি সম্মেলনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সার্বিক পরিস্থিতির হালনাগাদ চিত্র পাওয়া যাবে বলে মনে করছি। বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও অর্থায়ন সংকটের বিষয়টি তুলে ধরতে পারে। এসবের মাধ্যমে আগামী বছরের পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করে হয়তো বর্তমান অতিরিক্ত ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিপরিবর্তনের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের মানবিক সংকটে বিপুল অর্থ ব্যয় করায় রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকারের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে আটকে থাকা শরণার্থীদের জন্য এটি জীবন-মরণের প্রশ্ন।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এ পরিস্থিতিতে অন্য দাতা দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও কিছু আরব দেশ সীমিত সহায়তা অব্যাহত রেখেছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে শুধু মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়।