Image description

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। মাছের রাজা ইলিশ স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি পুষ্টিতে ভরপুর। ইলিশ মাছ শুধুমাত্র এর অনন্য স্বাদ এবং সুঘ্রাণের কারণে দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রতিবেশী ভারতের বাংলাভাষী মানুষের কাছেও ইলিশ খুবই লোভনীয় মাছ।

সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ইলিশের আকাশচুম্বী দামের মূল কারণ হলো এর স্বাদ এবং জনপ্রিয়তা। তবে অন্যান্য অনেক মাছ আছে যেগুলোর পুষ্টিগত মান খুবই ভালো কিন্তু দাম তুলনামূলকভাবে কম।

ক্রেতার মানসিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা সাধারণত স্বাদের জন্যই বেশি অর্থ দিতে প্রস্তুত থাকে। তবে পুষ্টিগুণের দিক থেকে যারা সচেতন, তারা হয়তো খাদ্যমানকেও মূল্যায়ন করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ভোক্তাই স্বাদের জন্যই বেশি অর্থ খরচ করতে রাজি থাকেন।

বাজারে ইলিশের এ অস্বাভাবিক দাম অনেককে হতবাক করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মা ইলিশ এবং জাটকা রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভোক্তারা যখন বাজারে কেনাকাটা করেন, তখন তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় স্বাদ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে, পুষ্টিগুণ নিয়ে খুব বেশি ভাবেন না। স্বাদ অনেক ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্য সব কিছুর চেয়ে এগিয়ে থাকে।

বর্তমানে ইলিশ মাছের ভরা মৌসুমে নিম্নবিত্ত তো বহুদূর, অনেক মধ্যবিত্তের পাতেও ওঠে না ইলিশ। এর মূল কারণ উচ্চমূল্য। ক্রেতাদের অভিযোগ, কোনো উৎপাদন খরচ না থাকলেও এই মাছ নিয়ে বরাবরের মতো এবারও বাজারে এক ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয়। তারা ইলিশ ধরা থেকে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায় এই সুস্বাদু মাছ। মৎস্য অধিদপ্তরের বক্তব্যও প্রায় একই রকম। কিন্তু মাছ ধরা জেলেসহ ব্যবসায়ীদের দাবি, ইলিশ ধরতে খরচ বেশি বলে বাজারে দাম বাড়তি দেখা যায়।

ঢাকার বাজারে এক কেজির ইলিশের দাম আকারভেদে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এমনকি চাঁদপুরে আড়তেও এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। ছোট ইলিশ হালি হিসেবে বিক্রি হলেও তার দামও সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ভারী।

ভোক্তাদের অভিযোগ, সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বাজারে এক ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। জেলেদের কাছ থেকে মহাজন, আড়তদার হয়ে পাইকারদের হাতে গিয়ে খুচরা পর্যায়ে পৌঁছাতে মাছের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মৎস্য অধিদপ্তরও বলছে, উৎপাদন খরচের চেয়ে সিন্ডিকেটের প্রভাবেই দাম বেশি।

তবে জেলে ও ব্যবসায়ীদের দাবি, ইলিশ ধরতে খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। পরিবহন, বরফ, প্যাকেজিং, শ্রমিক খরচসহ নানা অজুহাতে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ে।

অন্যদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে খুচরা পর্যায়ে ইলিশের গড় দাম ছিল ৫৯০ টাকা, যা এখন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। অথচ একই সময়ে রুই, কাতলা বা তেলাপিয়ার দামে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধির জন্য চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত আহরণ বা সরবরাহকে দায়ী করছেন জেলেসহ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইলিশ নদী বা সাগর থেকে বাজারে আনতে খরচের তুলনায় কম ধরা পড়ছে, যেজন্য দাম বাড়ছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে একক প্রজাতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় ইলিশ। আর বিশ্বে যত ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার ৮০ শতাংশের বেশি ধরা পড়ে বাংলাদেশে। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ ইলিশ। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। জেলেরা বছরে প্রায় ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণ করেন, যার বেশির ভাগই আসে সাগর থেকে।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ইলিশ উৎপাদন বেশ বেড়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নদী ও সাগরে ৫ লাখ ২৯ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়েছে।

মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মহাজনি প্রথাসহ নানা স্তরে সিন্ডিকেটের প্রথা ইলিশের দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। এর পেছনে জেলে মাছ ধরা থেকে শুরু করে ভোক্তা ক্রয়ের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের অনিয়ম বড় বিষয়। যার মধ্যে তেলের দাম না কমা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও ট্রান্সপোর্ট খরচ না কমা, আবার কৃত্রিম পরিবহন সংকট দেখানো, বরফের কৃত্রিম সংকট দেখানোসহ পাইকার বাজারের আড়তদারদের মূল্য নির্ধারণ সিন্ডিকেট বড় ভূমিকা পালন করছে।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করছেন, যা সরকারিভাবে মনিটর করে থামাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কম এবং খরচ বেশি হওয়ায় দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

সার্বিকভাবে ইলিশের দাম এতটা চড়া থাকার পেছনে রয়েছে সরবরাহ সংকট, চাহিদা বৃদ্ধি, সিন্ডিকেট এবং ইলিশ সংরক্ষণের যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া।

বাংলাদেশে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরণ হয়। প্রতি বছর উৎপাদন বেড়েছে ৫ লাখ টনেরও বেশি। তবুও সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং সিন্ডিকেটের প্রভাবেই ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সব মিলিয়ে ভরা মৌসুমেও ইলিশ যেন অনেকের জন্য স্বপ্নের মাছ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা এবং কার্যকর বাজার মনিটরিং ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

ঢাকাটাইমস